Wednesday 5 April 2017

১৩৬তম আইপিইউ সন্মেলনঃ বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার হাতছানি?

০৬ এপ্রিল ২০১৭

পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের একটি এসোসিয়েশন হিসেবে এই সংস্থাটির জন্ম ১৮৮৯ সালে। র সদস্যসংখ্যা এবার ১৭১ থেকে ১৭৩ হয়ে গেল; অর্থাৎ এর পরিধি বিশ্বব্যাপী এবং এর সদস্য নয়, এমন দেশ হাতে গোণা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি কেনো, অথবা এই সংস্থাটির নাম শোনানো হয়নি কেন? উত্তর সহজ – যুক্তরাষ্ট্র চায়নি বলে!

বাংলাদেশে মাত্র হয়ে গেল ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সন্মেলন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিদের একটি এসোসিয়েশন হিসেবে এই সংস্থাটির জন্ম ১৮৮৯ সালে; ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। এর জন্ম দিয়েছিল তখনকার বিশ্বের শক্তিধর দেশ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। এর সদস্যসংখ্যা এবার ১৭১ থেকে ১৭৩ হয়ে গেল; অর্থাৎ এর পরিধি বিশ্বব্যাপী এবং এর সদস্য নয়, এমন দেশ হাতে গোণা। এই সংস্থাটির মাধ্যমেই বেশকিছু ইন্টার-গভর্নমেন্ট সংস্থার জন্ম হয়েছিল, যেমন জাতিসংঘ। সংস্থাটিকে ভিত্তি করে জাতিসংঘের ইন্টার-পার্লামেন্টারি এসেম্বলি তৈরি করার চেষ্টাও করেছিল কিছু সংগঠন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থার নাম বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি কেনো, অথবা এই সংস্থাটির নাম শোনানো হয়নি কেন? উত্তর সহজ – যুক্তরাষ্ট্র চায়নি বলে!

যুক্তরাষ্ট্র কেন আইপিইউ-তে নেই?

১৮৮৯ সালে সংস্থাটির জন্মের সময়েই যুক্তরাষ্ট্র এর সাথে জড়িত থাকলেও অফিশিয়ালি যুক্তরাষ্ট্র এতে যুক্ত হয় ১৯৩৫ সালে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর চার বছর আগে। মার্কিন কংগ্রেস এবং সিনেট থেকে অনুমতি আসার পরেই যুক্তরাষ্ট্র এতে যুক্ত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা। জার্মানি-জাপান-ইতালি কিছুদিনের জন্যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। তবে যুদ্ধ শেষ হবার পরে পৃথিবীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। পুরো ইউরোপে যখন একটিও বিল্ডিং দাঁড়িয়ে ছিল না, তখন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বোমাও পড়েনি। দুনিয়ার সকলে ঐ মুহুর্তেই বুঝে গিয়েছিল যে বিশ্বযুদ্ধ কাকে উঠিয়েছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের গোড়াপত্তনে তাই মার্কিন প্রভাব ছিল সবচাইতে বেশি; আজও রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে মার্কিনীরা এমনভাবে তৈরি করে, যাতে চাবি থাকে তাদের হাতে। এই সংস্থা বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি ছাড়া বাকি সকলকেই নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ছিল সবসময়, যদিও কাগজে-কলমে তার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ প্রতিহত করা। যাইহোক, বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের কর্তৃত্ব কমতে থাকার সাথেসাথে তাদের তৈরি করা সংস্থাগুলিও চাপা পড়ে যেতে থাকে। এর স্থলাভিষিক্ত হয় নতুন তৈরি করা মার্কিন সংস্থাগুলি। যেসকল সংস্থার গুরুত্ব কমে যেতে থাকে, তার মাঝে একটি ছিল আইপিইউ। মার্কিন জনপ্রতিনিধিরা ধীরে ধীরে আইপিইউ-তে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। আর ১৯৯৭ সালে মার্কিন কংগ্রেস থেকে আইপিইউ-এর কাছে একটি চিঠি দিয়ে বলা হয় যে যেহেতু মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা সেখানে আর যাচ্ছেন না, তাহলে আইপিইউ-এ মার্কিনীদের বাৎসরিক চাঁদা এক মিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে আধা মিলিয়ন ডলার করা যায় কিনা। আইপিইউ-এর এক্সিকিউটিভ কমিটি মার্কিন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। মাত্র এক মিলিয়ন ডলার দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কঠিন হয়ে যাওয়ায় ১৯৯৯ সালের পহেলা অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস করে যুক্তরাষ্ট্র অফিশিয়ালি আইপিইউ থেকে বের হয়ে যায়। অর্থাৎ গত ১৭ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্র এর সদস্য নয়, যদিও সংস্থাটির সদস্য পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্র – গণতান্ত্রিক হোক, আর না হোক। ১৯০৪, ১৯২৫ এবং ১৯৫৩ সালের তিনটি সন্মেলন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতও হয়েছিল।


সংস্থার বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ক্যামেরুনের নাগরিক মার্টিন চুংগং বলেন যে কিছু দেশ নিরাপত্তার ঘাটতির কথা বলে বাংলাদেশের স্বাগতিক দেশ হবার বিরুদ্ধে   কঠোর আপত্তি জানায়। তবে বাকি বেশিরভাগ দেশ সমর্থন দেয়ায় প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের মার্চে প্রথম আফ্রিকান সেক্রেটারি জেনারেল হন চুংগং, এবং একইসাথে ২০১৪ সালেরই অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে তিন বছরের জন্যে সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। এই সময়টি থেকেই নতুন ইতিহাস রচিত হতে থাকে।

২০১৪ থেকে ২০১৭

সংস্থাটির হেডকোয়ার্টার্স হলো সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এর আগের ১৩৫টি সন্মেলনের মাঝে ২০টি সন্মেলনই হয়েছে সুইজারল্যান্ডে; এর মাঝে ২০০৩ থেকে ২০১৬-এর মাঝে ১৪টি সন্মেলন সুইজারল্যান্ডে হয়। ২০০১ সালের পর থেকে জাম্বিয়া, ইকুয়েডর, পানামা, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, বুরকিনা ফাসোর মতো দেশেও এই সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু বাংলাদেশে একবারও হয়নি। এই দেশগুলির নাম দেখলেই বোধ করা যায় যে আয়োজকের যোগ্যতা কোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল না কখনোই। কিন্তু সেটাকেই ইস্যু করা হয় যখন বাংলাদেশ ১৩৬তম সন্মেলন ঢাকায় করার প্রস্তাব দেয়। এই সংস্থার বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ক্যামেরুনের নাগরিক মার্টিন চুংগং বলেন যে কিছু দেশ বাংলাদেশে নিরাপত্তার ঘাটতি আছে বলে কঠোর আপত্তি জানায়। তবে বাকি বেশিরভাগ দেশ সমর্থন দেয়ায় প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। ২০১৪ সালের মার্চে প্রথম আফ্রিকান সেক্রেটারি জেনারেল হন চুংগং, এবং একইসাথে ২০১৪ সালেরই অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে তিন বছরের জন্যে সংস্থার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। এই সময়টি থেকেই নতুন ইতিহাস রচিত হতে থাকে।


ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩৬তম আইপিইউ সন্মেলনে ১৩২টি দেশের জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেয়। সেখানে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনা হয়। বলা হয় যে জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্র রক্ষা, মানবাধিকার, ইত্যাদি ছুতো ব্যবহার করে অন্য দেশের ভেতরে নাক গলানো যাবে না। উদাহরণস্বরূপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপগুলিকেই হাইলাইট করা হয়। এই প্রস্তাবটি নিয়েই কয়েকদিন ধরে নাটকীয় বাকবিতন্ডা হয় এবং অবশেষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘে এই প্রস্তাব আনা কখনোই সম্ভব ছিল না; যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব তুলতেই দিতো না। তুলতে পারলেও হয়তো ভেটো দিয়ে দিতো। যুক্তরাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মতো আইপিইউ-তে কারো ভেটো প্রদানের ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ এই সন্মেলনের আয়োজক হবার প্রস্তাব দেয়ার সাথেসাথেই একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্র বাধা দিতে চেয়েছিল। তারা বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসীদের আখড়া বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। তাদের সেই চেষ্টা তো ব্যর্থ হলোই, একইসাথে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্রও বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি নস্যাৎ করে দেয়। তারা এই সন্মেলনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই তাদের পরিকল্পনাগুলি আঁটতে থাকে। যেটার উপরে পুঁজি করে তারা বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ প্রমাণ করতে চেয়েছিল; চেয়েছিল সামরিক-বেসামরিক চুক্তি করে নিয়ন্ত্রণের বলয় শক্ত করতে; চেয়েছিল এদেশের সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করতে, সেটাই এখন পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদেশী গোয়ান্দা সংস্থার অন্তর্ধানমূলক কর্মকান্ড, বিশেষ করে মার্কিন সিআইএ এবং ভারতের ‘র’-এর একত্রে কাজ করার প্রয়াস, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। আইপিইউ-এর অন্য দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত এই সাম্রাজ্যবাদী চক্রের গালে চপেটাঘাত।


অন্যায্য বিশ্ব-ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের পথ খুঁজছে সবাই। বাংলাদেশে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সকল ষড়যন্ত্রকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে এবং একইসাথে এই সন্মেলনগুলির মাঝ দিয়ে মার্কিন বিশ্ব-ব্যবস্থার বিকল্প একটি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী ।

বিকল্প বিশ্ব-ব্যবস্থার খোঁজে

আইপিইউ সন্মেলন এবং কিছুদিন আগে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া আইওআরএ-এর শীর্ষ বৈঠক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ার বার্তা বহন করছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ জানান দিচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রের অবস্থান বেশ শক্ত। ১৯৯০ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে মার্কিন আদর্শকে দুনিয়াব্যাপী রক্ষা করার একটি পদ্ধতি হলো মুসলিম দেশগুলির সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়া। মুসলিম দেশগুলিকে বিভিন্নভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখে বা সেসব দেশে সামরিক-বেসামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্বল করে দিয়ে দুনিয়াব্যাপী তার আদর্শকে জারি রাখাই সেই পদ্ধতির অংশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরির মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলির শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে, যাতে যেকোন সময়ে সেসব দেশে সামরিক-বেসামরিক হস্তক্ষেপ করা যায়। নিজেদের হাতে হাজারো পারমাণবিক অস্ত্র রেখে দিয়ে ‘ওয়েপনস অব ম্যাস ডেসট্রাকশন’এর মিথ্যা কথা বলে ইরাককে ধ্বংস করেছে। ইরাকের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে নিঃসন্দেহে ২০০৩ সালের সেই যুদ্ধ এড়ানো যেত; বাঁচতো লাখো মুসলিমের জীবন। দুনিয়াতে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী দেশটিই বাকি সকল দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র রাখা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে। একই কাহিনী কেমিক্যাল এবং জীবানু অস্ত্রের ক্ষেত্রেও। সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার মুসলিম জনগণের উপরে কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলেই মার্কিনীরা চুপ করে থেকেই ক্ষান্ত হয়নি, দিয়েছে পরোক্ষ সমর্থন। এই অন্যায্য বিশ্ব-ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের পথ খুঁজছে সবাই। বাংলাদেশে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সকল ষড়যন্ত্রকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে এবং একইসাথে এই সন্মেলনগুলির মাঝ দিয়ে মার্কিন বিশ্ব-ব্যবস্থার বিকল্প একটি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে, যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী ।

No comments:

Post a Comment