Monday 12 February 2024

মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ – প্রতিবেশী বাংলাদেশের সামনে অপশন

১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হওয়া অকটেন এবং সয়াবিন তেলের বিশাল চালান। চোরাচালানের ধরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাখাইনের এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলি লজিস্টিক্যাল সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে সরকারের কাছ থেকে দখল করা যানবাহণ চালাবার জন্যে পেট্রোল বা অকটেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌযান চালানোর জন্যে ব্যবহৃত ডিজেল এবং বিদ্রোহী সেনাদের খাবার রান্নার জন্যে খাবার তেল এবং মসলা-জাতীয় পণ্যের সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি দৃশ্যমান।


তেল, পিঁয়াজ, আদা, রসুন!

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তে গোলাগুলি, গুলিতে হতাহত মানুষ, সীমান্ত ছাড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার ও রকেট, শতশত মিয়ানমার সামরিক সদস্যের বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবির কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ, বিজিবির হাতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বেসামরিক ব্যাক্তির গ্রেপ্তার, ইত্যাদি সংবাদ হেডলাইন হয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত কম জানাজানি হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তে চোরাচালানের ধরণ পরিবর্তনের গল্প। যে ব্যাপারটা এতকাল জানাই ছিলো তা হলো, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ইয়াবা, গাঁজা, ক্রিস্টাল মেথ ইত্যাদি মাদক। আর এর পেমেন্ট হয় ভারতের সাথে কুষ্টিয়া ও যশোর সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণের মাধ্যমে। তবে এবার মিয়ানমারের মাদকের পেমেন্ট দেয়া হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়েই – বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে। এই পণ্যের মাঝে প্রথমেই রয়েছে জ্বালানি তেল (অকটেন এবং ডিজেল), খাবার তেল (সয়াবিন), এবং আরও কিছু মসলা-জাতীয় খাবার; যেমন পিঁয়াজ, আদা, রসুন। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মাঝে একমাসে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে সাড়ে ৭ টনের বেশি অকটেন এবং প্রায় ৪ টনের মতো সয়াবিন তেল। গত ২৫শে ডিসেম্বর একদিনে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়েছে ১৮'শ লিটার অকটেন, ৩৭'শ লিটার সয়াবিন তেল এবং ১'শ ৩৬ লিটার ডিজেল।

এই মালামালগুলি মিয়ানমারে কাদের হাতে যাচ্ছে? মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির ৩'শ ৩০ জন সদস্যের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কাহিনীই বলে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত এখন কাদের দখলে। মিয়ানমারের সরকারি এই সেনারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে পালাতে পারেনি; তাই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আর তাদের সংখ্যা বলে দিচ্ছে যে, বিদ্রোহী গ্রুপের সামরিক শক্তি কতটুকু। তবে একইসাথে চোরাচালানের ধরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাখাইনের এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলি লজিস্টিক্যাল সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে সরকারের কাছ থেকে দখল করা যানবাহণ চালাবার জন্যে পেট্রোল বা অকটেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌযান চালানোর জন্যে ব্যবহৃত ডিজেল এবং বিদ্রোহী সেনাদের খাবার রান্নার জন্যে খাবার তেল এবং মসলা-জাতীয় পণ্যের সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি দৃশ্যমান। ব্যাপারটা এমন নয় যে, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই ঘাটতিগুলি ছিল না। বরং মিয়ানমার সরকার নিজস্ব লজিস্টিকস ব্যবস্থায় এই ঘাটতিগুলি পূরণ করতে পারতো। বিদ্রোহীরা রাখাইনের বড় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিলেও লজিস্টিকসের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই; যা কিনা যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।

রাখাইনে বিদ্রোহী গ্রুপের হাতে দখল হওয়া সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। যেকোন সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সিকে এগিয়ে নিতে হলে যে শর্তগুলি পূরণ আবশ্যকীয়, তার মাঝে একটা হলো বাইরের কোন শক্তির সমর্থন। এই সমর্থন হতে হবে রাজনৈতিক, সামরিক, আর্থিক এবং লজিস্টিক্যাল। বাইরের সমর্থন ছাড়া যেকোন সশস্ত্র সংগ্রাম বেশিদূর এগুতে পারে না।




সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সির স্বরূপ

যেকোন সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সিকে এগিয়ে নিতে হলে যে শর্তগুলি পূরণ আবশ্যকীয়, তার মাঝে একটা হলো বাইরের কোন শক্তির সমর্থন। এই সমর্থন হতে হবে রাজনৈতিক, সামরিক, আর্থিক এবং লজিস্টিক্যাল। বাইরের সমর্থন ছাড়া যেকোন সশস্ত্র সংগ্রাম বেশিদূর এগুতে পারে না। একারণেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি হয় বাইরের সমর্থনে সংগ্রাম শুরু করে অথবা কোন এক সময় বাইরের সমর্থন খোঁজে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন বিদ্রোহীদেরকে কোণঠাসা করে ফেলতে উদ্যত হয়, তখন বিদ্রোহীরা বাইরের, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সীমান্তের সাথে লাগোয়া অন্য রাষ্ট্রগুলির সমর্থন চায়। সেই রাষ্ট্র হয় জাতিরাষ্ট্রের সীমানার কনসেপ্টকে মেনে চলে অথবা সেটাকে ভেঙ্গে ফেলে। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়ান চুক্তির আওতায় লিপিবদ্ধ করা জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলির একটা হলো, একটা রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সীমানাকে মেনে চলবে এবং সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

এই কনসেপ্টগুলি অনুযায়ী জাতিরাষ্ট্রের বাউন্ডারিগুলি আজও পরিচালিত হলেও নিয়মগুলিকে নিয়মিতই বাঁকানো হয়েছে। তবে সেটা মূলতঃ সম্ভব হয়েছে জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলিকে লালন-পালন করা শক্তিশালী দেশগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির মদদ ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলি জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলিকে বাঁকানোর সাহস করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উসমানি খিলাফত থেকে আলাদা হবার জন্যে আরবদেরকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল ব্রিটেন। 'লরেন্স অব এরাবিয়া' নামে মুভি তৈরি করে এই ব্যাপারটাকে পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা দেয়া হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারতের পিছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ এবং ব্রিটেনের পরোক্ষ মদদ ছিলো। ১৯৮০এর দশকে আফগান মুজাহিদদের সহায়তা দেয়া পাকিস্তানের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিলো। শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীদের ভারতীয় সমর্থনের পিছনে ইউরোপিয়দের মদদ ছিলো। ভিয়েতনাম যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিদ্রোহীদের পিছনে উত্তর ভিয়েতনামের সরাসরি সমর্থন সম্ভব হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে। ১৯৬০এর দশকে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা বিদ্রোহীদেরকে বড় কোন রাষ্ট্র সরাসরি মদদ না দিলেও ক্যাথোলিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে পরোক্ষ মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং আরও কিছু দেশ।

তবে এক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী দেশগুলির অবস্থান হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সীমান্ত হলো লজিস্টিক্যাল সহায়তা পাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এছাড়াও রাষ্ট্রের যদি সমুদ্রসীমা থাকে, তাহলে বিদ্রোহীরা সেই সমুদ্রসীমা ব্যবহার করেও লজিস্টিক্যাল সহায়তা পেতে পারে। যেমন, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীরা গভীর সমুদ্রে অবস্থান করা জাহাজ থেকে ছোট ছোট বোটে করে সাপ্লাই আনার ব্যবস্থা করতো। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বিমান পথেও এটা সম্ভব। যেমন, বায়াফ্রা যুদ্ধের সময় নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী বায়াফ্রা অঞ্চলের সমুদ্রসীমা দখলে নিয়ে নিলে বিমানের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হতো। এতে সাপ্লাই নিয়ে অবতরণের সময় নাইজেরিয় বাহিনীর গুলিতে বহু পরিবহণ বিমান ভূপাতিত হয়েছিল।



মিয়ানমারের ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহগুলির বেশিরভাগই অনেক পুরোনো। এই লেখার উদ্দেশ্য নয় এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বরং এখানে যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বিদ্রোহী গ্রুপগুলির কে কার কাছ থেকে রাজনৈতিক এবং লজিস্টিক্যাল সহায়তা পাচ্ছে, সেটা খুঁজে দেখা। কারণ এই সহায়তা দেয়ার পিছনে একটা রাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়। মিয়ানমার একটা কৃত্রিম রাষ্ট্র; যা ব্রিটিশরা তৈরি করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এই রাষ্ট্রের বাউন্ডারিগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে করে আশেপাশের রাষ্ট্রগুলির সাথে এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। মিয়ানমারের আয়তন বিশাল; কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকার সাথে রাজধানী এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলির যোগাযোগ দুর্গম। দেশের একটা বড় অঞ্চল বনভূমি এবং পাহাড়ি; যার মাঝ দিয়ে গিয়েছে প্রচুর নদনদী। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে মিয়ানমারে সারাবছর ধরে স্থল পরিবহণ বেশ কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমার ছিল জাপানি বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ এবং তার মিত্রদের একটা ফ্রন্ট। প্রায় চার বছর ধরে মিয়ানমারে যুদ্ধ চলেছে। যুদ্ধে শত্রুর গুলির চাইতে বেশি সেনা হতাহত হয়েছে মিয়ানমারের বৈরী পরিবেশের কারণে। এটা সবচাইতে খারাপ যুদ্ধক্ষেত্রগুলির মাঝে একটা বলে ইতিহাতে পরিচিত। উভয় পক্ষই দুই লক্ষাধিক সেনা হারিয়েছে। আর বার্মিজরা হারিয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।


রাখাইন প্রদেশের লজিস্টিক্যাল বাস্তবতা

মিয়ানমারের বাকি অংশ থেকে আরাকান বা রাখাইন ভৌগোলিকভাবে আলাদা। এর কারণ হলো আরাকান পর্বত; যা কিনা হিমালয়ের একটা শাখা। প্রায় সাড়ে ৯'শ কিঃমিঃ লম্বা এই পর্বতের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১০ হাজার ফুট। এই পর্বতের মাঝ দিয়ে যাবার রাস্তা মাত্র দু'টা। মূলতঃ এই দু'টা রাস্তার মাধ্যমেই রাখাইন রাজ্য বাকি মিয়ানমারের সাথে যুক্ত। রাজধানী নে-পি-দো থেকে সড়কপথে রাখাইনের মূল শহর সিতওয়ে (প্রাক্তন আকিয়াব) যাওয়া যায় এই দুই পথের একটা দিয়ে। সাধারণ হিসেবে সাড়ে ৬'শ কিঃমিঃ এই রাস্তা পাড়ি দিতে ১৪ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। প্রাক্তন রাজধানী রেঙ্গুন (যা ১ হাজার কিঃমিঃ দূরে) থেকে সড়কপথে সিতওয়ে আসতে লাগে কমপক্ষে সাড়ে ১৮ ঘন্টা। এর মাঝে আবার রাখাইন রাজ্যে রয়েছে বড় কয়েকটা নদী; যেগুলির উপর দিয়ে সেতুর সংখ্যা সীমিত। এই দুর্গম পরিবহণ ব্যবস্থার কারণে রাখাইনের সাথে বাকি মিয়ানমারের মূল যোগাযোগ হয় সমুদ্রপথে। রাখাইনের রয়েছে ৪'শ কিঃমিঃএর বেশি লম্বা সমুদ্রতট; যেখানে রয়েছে কয়েকটা সুমুদ্রবন্দর। রাখাইনের সিতওয়ে এবং কিউকপিউ বন্দরে জাহাজ আসে রেঙ্গুন থেকে। মাঝে মাঝে জাহাজগুলি নাফ নদী দিয়ে মংডু পর্যন্তও যায়। এসব কারণেই ১৯৯০এর দশক থেকে মিয়ানমার তার নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্রিয় হয়েছে। আন্তর্জাতিক অবরোধ এবং নিজস্ব সামরিক ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতার কারণে মিয়ানমার তার নৌবাহিনীর বেশিরভাগ জাহাজ নিজেরাই তৈরি করেছে। রাখাইন রাজ্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই নৌসক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেনা এবং রসদ পরিবহণ করার জন্যে মিয়ানমার নৌবাহিনীর ৮টার মতো পুরোনো সেনা পরিবহণ এবং ৫টা মালামাল পরিবহন জাহাজ রয়েছে। এই জাহাজগুলি রাখাইনের বন্দরগুলিতে ভিড়তে পারে। তবে বন্দরের বাইরে সমুদ্রতট ব্যবহার করে রসদ নামাবার জন্যে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে রয়েছে পুরোনো ১০টা ল্যান্ডিং ক্রাফট; এবং ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মাঝে নিজেদের দেশে তৈরি করা ২৬টা ল্যান্ডিং ক্রাফট। নতুন ২৬টা ল্যান্ডিং ক্রাফট একত্রে ৬৪টা সাঁজোয়া যান বহণে সক্ষম। তবে রাখাইনকে নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারের সবচাইতে বড় পদক্ষেপ ছিল প্রায় ১৫ হাজার টনের বিশাল উভচর যুদ্ধজাহাজ 'মোয়াত্তামা'। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অবরোধকে হাসিঠাট্টার খোরাক বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া এই জাহাজটা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে। এই জাহাজ একসাথে ৩৫টার মতো সামরিক গাড়ি, সাড়ে ৩'শ সেনা এবং ২টা ল্যান্ডিং ক্রাফট বহণ করে। তবে স্বল্প দূরত্বের জন্যে এই জাহাজ আরও অনেক বেশি সেনা বহণ করতে পারে। সেনা এবং রসদ বহণের সক্ষমতা ছাড়াও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে রয়েছে ৫টা ফ্রিগেট, ৩টা কর্ভেট, ৪টা ওপিভি; যেগুলি দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রে টহল দিতে সক্ষম। এর বাইরেও তাদের রয়েছে উপকূলের কাছাকাছি টহল দেয়ার মতো বহু ছোট ছোট প্যাট্রোল বোট। এই জাহাজগুলি অন্ততঃ কাগজে কলমে হলেও রাখাইনের উপকূলকে অবরোধ দেয়ার সক্ষমতা রাখে। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সমুদ্রপথে বাইরে থেকে সহায়তা পেতে হলে মিয়ানমার নৌবাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে হবে। আর সেটা কষ্টকর হলে রাখাইনের সাথে যে দেশগুলির স্থল সীমান্ত রয়েছে, সেই দেশগুলির সরাসরি বা পরোক্ষ সহায়তা চাইবে। কারণ আরাকান পর্বত পারি দিয়ে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল ঘুরে রাখাইনে খুব কমই রসদ আসা সম্ভব। আর বাস্তবতা হলো, রাখাইনের সাথে স্থলসীমান্ত রয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের। উত্তরে বাংলাদেশ, পূর্বে আরাকান পর্বত, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর – এর মাঝেই হলো রাখাইন।

রাখাইনের কিউকপিউ-তে চীন একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে; যেখানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের জাহাজগুলি তেল খালাস করবে এবং এই তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাবে। এর ফলে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে বাইপাস করে চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। যদিওবা এর পরিমাণ চীনের চাহিদার তুলনায় তেমন কিছুই নয়; তথাপি 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতার মাঝে এর গুরুত্ব যথেষ্ট। চীন এই প্রকল্পগুলি হাতে নেবার পর থেকেই রাখাইনে গণহত্যা শুরু হয়েছে এবং এর স্বাভাবিক ফলাফল হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ; যা এখন চীনা প্রকল্পগুলিকে হুমকির মাঝে ফেলেছে। 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতাতে চীনকে 'ব্যাকফুটে' রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যাতে করে বাংলাদেশ তার নীতি পরিবর্তন করে রাখাইনের বিদ্রোহীদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট নিশ্চিত করে; অথবা অন্ততঃ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে সীমানার কিছু অংশ ইয়াবার বিনিময়ে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যকে চলতে দেয়। বলাই বাহুল্য যে, এতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য।


রাখাইনের জাতীয়তাবাদ এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

রাখাইন রাজ্যে রয়েছে বহু উগ্র জাতীয়তাবাদী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু ১৯৪২ সালেই রাখাইনের জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের হাতে প্রায় ৪০ হাজার মুসলিম নিহত হয়। ১৯৭০-এর দশকে একবার; ১৯৯০এর দশকে আরেকবার; এবং ২০১৬এর পর থেকে রাখাইনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পাশবিক হামলার সময় এই জাতীয়তাবাদীরা সরাসরি অংশ নেয় এবং মুসলিমদের ধনসম্পদ দখলে যথেষ্ট পারদর্শীতা দেখায়। সেসময় অবশ্য বিশ্বব্যাপী রাখাইনের মুসলিমদের পক্ষে খুব কমই সহমর্মীতা দেখা গিয়েছিল। জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলি মিয়ানমারকে পৃথিবীর সবচাইতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ-কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলো। কথাসর্বস্ব সহমর্মীতাকে ছাপিয়ে মিয়ানমারে মার্কিন-সমর্থিত গণতন্ত্রকামীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসাটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। চীনের সীমান্ত রাষ্ট্র মিয়ানমারে একটা মার্কিন-সমর্থিত রাষ্ট্রের অবস্থান ভূরাজনৈতিক দিক থেকে হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় কেউই রাখাইনের মুসলিমদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়নি; কারণ এতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটা পিছিয়ে যেতে পারে। ১৯৯১ সালে মার্কিন-সমর্থিত গণতন্ত্রী নেতা অং সান সু-কি-কে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার পর সু-কি তার পুরষ্কারকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগান ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে। রাখাইনের মুসলিমদের উপর গণহত্যার ব্যাপারটাকে তিনি কতটা সুন্দরভাবে সমর্থন দিয়েছেন, তা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করলে যে গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ শুরু হয়, সেই বিদ্রোহের পক্ষে পশ্চিমা দেশগুলিকে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। অর্থাৎ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পাশবিকতা নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলির স্বার্থই ঠিক করেছে যে মিয়ানমারের কোন ব্যাপারটা সকলে গুরুত্ব দেবে।

জন্মের পর থেকে সাত দশক ধরে মিয়ানমারের বহু রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। এই বিদ্রোহগুলিকে সমর্থ দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলি। মিয়ানমারের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশটার স্থলসীমানার বিশাল অংশ মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না; এখনও নেই। এই অঞ্চলগুলি শাসন করে বিদ্রোহী গ্রুপগুলি। এদের রয়েছে নিজস্ব অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী এবং আইন ব্যবস্থা। অর্থাৎ মানচিত্রের মিয়ানমার, আর বাস্তবিক মিয়ানমার এক নয়। শক্তিশালী দেশগুলি, বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন মিয়ানমারের অঞ্চলটাতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতেই প্রচুর সম্পদশালী এই দেশটার এমন অবস্থা করে রেখেছে। রাখাইনে বরং এরূপ সশস্ত্র বিদ্রোহ নতুন; কারণ রাখাইন চীনের সীমানায় নয়। রাখাইনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে যখন রাখাইনের উপকূলে গ্যাসের খনি আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে এই খনি থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের কুনমিং প্রদেশে গ্যাস রপ্তানি শুরু হয়। একইসাথে রাখাইনের কিউকপিউ-তে চীন একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে; যেখানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের জাহাজগুলি তেল খালাস করবে এবং এই তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাবে। এর ফলে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে বাইপাস করে চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। যদিওবা এর পরিমাণ চীনের চাহিদার তুলনায় তেমন কিছুই নয়; তথাপি 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতার মাঝে এর গুরুত্ব যথেষ্ট। চীন এই প্রকল্পগুলি হাতে নেবার পর থেকেই রাখাইনে গণহত্যা শুরু হয়েছে এবং এর স্বাভাবিক ফলাফল হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ; যা এখন চীনা প্রকল্পগুলিকে হুমকির মাঝে ফেলেছে।

রাখাইনে সশস্ত্র বিদ্রোহ সেখানে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চীনা প্রকল্পগুলির প্রতি সরাসরি হুমকি। সেখানে যেকোন প্রকারের অরাজকতা এবং নাশকতা চীনকে বিচলিত করবে এবং 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতায় চীনকে চাপের মাঝে ফেলবে। রাখাইনের ভৌগোলিক বাস্তবতায় সেখানকার বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের স্থলসীমানার উপর নির্ভর করা ছাড়া খুব বেশি অপশন নেই। কারণ সমুদ্রপথ মিয়ানমার নৌবাহিনীর দখলে। বাংলাদেশ হলো রাখাইনের সবচাইতে কাছের ভূমি যেখানে যেকোন লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব; অন্ততঃ কাগজে-কলমে হলেও। এই কাগজে-কলমের ব্যাপারটা বাস্তবে রূপ পাবে কিনা, সেটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-নীতির উপর। 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতাতে চীনকে 'ব্যাকফুটে' রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যাতে করে বাংলাদেশ তার নীতি পরিবর্তন করে রাখাইনের বিদ্রোহীদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট নিশ্চিত করে; অথবা অন্ততঃ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে সীমানার কিছু অংশ ইয়াবার বিনিময়ে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যকে চলতে দেয়। বলাই বাহুল্য যে, এতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। আবার পশ্চিমারা এটাও চাইছে যে, রাখাইনের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যে সেখানকার সকল মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছে, সেই ব্যাপারটাও বাংলাদেশ যেন 'নরম' দৃষ্টিতে দেখে; অর্থাৎ এই উগ্র জাতীয়তাবাদীদেরকে বাংলাদেশ যেন 'মুসলিম-বিদ্বেষী' বলে আখা না দেয়। কাজেই রাখাইনের অস্থিরতা মূলতঃ চীন এবং বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই।



................................................


সূত্রঃ 



'মাদকের বিনিময়ে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে তেল, চাল, ডাল!’, সময় টিভি, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪,

‘Rise in fuel, edible oil smuggling to Myanmar prompts urgent action in Cox's Bazar’, The Business Standard, 17 January 2024

‘One held with 1,500 litres of oil while smuggling to Myanmar’, Dhaka Tribune, 13 December 2023

‘Waging Insurgent Warfare: Lessons from the Vietcong to the Islamic State’ by Seth G. Jones, 2017

‘War of the Flea: The Classic Study of Guerilla Warfare’ by Robert Taber, 2002

‘The Evolution of a Revolt’ by T E Lawrence, Army Quarterly and Defence Journal, October 1920

‘Out of the Mountain: The Coming Age of the Urban Guerilla’ by David Kilcullen, 2013

‘Afghanistan the Bear Trap: The Defeat of a Superpower’ by Mohammad Yousaf and Mark Adkin, 2001

‘The World was Going Our Way: The KGB and the Battle for the Third World’ by Christopher Andrew and Vasili Mitrokhin, 2005

‘Biafra: The Nigerian Civil War 1967-1970’ by Peter Baxter, 2019

‘Defeat into Victory’ by Field Marshal Sir William Slim, 1956

‘BGB takes 100 fleeing Myanmar border guards to Teknaf’ in BDNews24, 08 February 2024

‘Myanmar rebel group claims control of India border town’ in BBC, 15 January 2024

‘Myanmar Gives China Green Light to Proceed with Strategic Seaport’ in The Maritime Executive, 31 December 2023

‘Why is Myanmar’s new deep-sea port such hot property?’ in The Interpreter, Lowy Institute, 22 November 2023

Saturday 25 November 2023

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ডিটারেন্ট - পাঁচ দশকের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম

২৫শে নভেম্বর ২০২৩

পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা ডিটারেন্ট

ডিটারেন্ট এমন একটা জিনিস, যার মাধ্যমে একটা রাষ্ট্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু রাষ্ট্রকে হুমকি প্রদান করে - যদি শত্রু রাষ্ট্র তার উপর হামলা করে, তাহলে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। এই হুমকির পিছনে যদি সক্ষমতা এবং সদিচ্ছা থাকে, তাহলে শত্রু হয়তো হামলা করা থেকে বিরত থাকতে পারে। যুদ্ধ না করেই শত্রুকে বিরত রাখার কৌশলই হলো ডিটারেন্ট। একটা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ডিটারেন্ট নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমেই আসবে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কথা।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হলো ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব; কারুর সাথে শত্রুতা নয়’। নীতি প্রণয়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার হলেও এই নীতির বাস্তবায়নে বেশকিছু ধোঁয়াশা রয়েই গিয়েছে। যেমন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ যদি নীতি হয়, তাহলে তো বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কারণ বাংলাদেশ তো সকলকেই বন্ধু মনে করছে; বন্ধুদের সাথে তো যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কেউই তো বাংলাদেশকে মুচলেকা দিয়ে বলেনি যে, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন সংঘাতে যাবে না। বাংলাদেশ হয়তো সকল দেশকে বন্ধু মনে করতে পারে; কিন্তু সেই দেশগুলি নিজেরা কি একে অপরকে বন্ধু মনে করে? উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু মনে করছে। কিন্তু এই তিনটা দেশ কি একে অপরকে বন্ধু মনে করছে? এরা যদি একে অপরকে বন্ধু মনে না করে, তাহলে তারা কি বাংলদেশের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের বন্ধুত্বকে স্বাভাবিক চোখে দেখবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর সহজ নয়। এবং একইসাথে এখানে কোন রাষ্ট্রের শক্তি কতখানি, সেই হিসেবটা চলে আসে। কারণ বর্তমান পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিই চলমান। শক্তিশালী দেশের কাছে ছোট কোন দেশের নীত পছন্দ না হলে ছোট দেশকে রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধ, এমনকি সামরিক আগ্রাসনের শিকারও হতে হচ্ছে।

একারণে বাংলাদেশ প্রথম দিন থেকেই সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। এখানেই নীতি এবং নীতির বাস্তবায়নের মাঝে ফারাক। সকলকে বন্ধু হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরেও বাংলাদেশ ধরেই নিয়েছে যে, সেই বন্ধুদের মাঝে যে কেউ হঠাৎ করেই শত্রু হয়ে যেতে পারে। অন্য কথায় বলতে গেলে, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতি বাংলাদেশ মুখে বললেও কাজে সেটা কেউই বিশ্বাস করে না। তাহলে এটা কি একটা বিবৃতি মাত্র? নাকি এর পিছনে আরও কিছু রয়েছে?

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর 'এফ-৮৬ স্যাবর' ফাইটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘এফ-৮৬’ যুদ্ধবিমান ঢাকার আকাশে শত্রু বিমানের প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়; যা খুব বড় কিছু না হলেও গুরুত্বপূর্ণ; যদিও এই বিমানগুলির মেইনটেন্যান্স কতটা নির্ভরযোগ্য ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল তখনও।


ভারতের জন্যে ভূরাজনৈতিক শিক্ষা

১৯৭১ সালে ভারতের সরাসরি সহায়তা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা পেলেও নতুন রাষ্ট্র থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পরপরই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘এম-২৪’ ট্যাঙ্ক এবং ‘এফ-৮৬ স্যাবর’ যুদ্ধবিমান রিপেয়ার করে সেগুলিকে বাংলাদেশের নতুন সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এগুলি আবার ১৯৭২ সালের সামরিক প্যারেডে প্রদর্শিতও হয়। ভারতীয়রা নতুন তৈরি হওয়া বাংলাদেশের উপর তাদের প্রভাব ধরে রাখতে সকল প্রচেষ্টাই করেছে; যার মাঝে ছিল বাংলাদেশকে সীমিত সংখ্যক সামরিক সরঞ্জাম প্রদান। তবে সেসময় ভারতের সামরিক সক্ষমতারও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যেকারণে কিছু সেকেন্ড-হ্যান্ড ‘এলিউট-৩’ হেলিকপ্টার, প্যাট্রোল বোট এবং আরও কিছু সরঞ্জাম তারা বাংলাদেশকে আনুদান হিসেবে দেয়। তবে এগুলি বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তেমন কোন ভূমিকা রাখেনি।

১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত ভূরাজনৈতিক চাপ অনুভব করতে থাকে বিভিন্ন দিক থেকে। একটু দেরিতে বুঝলেও দিল্লীর কাছে এটা অন্ততঃ পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারত বাংলাদেশের জন্মদাতা বলে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী দেশগুলির (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন) ইচ্চা থাকার কারণেই ভারত এই কাজটা সম্পাদন করতে পেরেছে। একদিকে যেমন ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এটা চেয়েছিল, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পায়নি। বরং পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে চীনের সাথে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করাটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে মৌখিক সমর্থন দিয়ে গেছে; কোন সামরিক সহায়তা দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিশ্চিত করেছে যাতে করে নতুন তৈরি হওয়া বাংলাদেশে কোন বামপন্থী দল ক্ষমতায় না আসতে পারে। একারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুজিব বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ‘এম-১৬’ রাইফেলও দিয়েছে; যেগুলির ৫ দশমিক ৫৬মিঃমিঃ ক্যালিবারের গোলা এই উপমহাদেশের আর কোন রাইফেল বা মেশিনগানে ব্যবহারই হয় না।

ভারত ভূরাজনীতি কম বুঝলেও আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের প্রথম থেকেই ঢাকার কর্তাব্যক্তিরা ভারতের চাইতে ভূরাজনীতি বেশিই বুঝেছিল। একারণেই ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেকগুলি দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়; যা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে ভারতের প্রভাবকে কমাতে থাকে। অন্য কথায় বলতে গেলে, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতিটা ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে যেতে থাকে। কারণ ভারত চেয়েছিল ঢাকার নীতির উপর একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রাখতে। প্রকৃতপক্ষে এই নীতির মূল জায়গাটা হলো ব্যালান্সিং; বড় বড় রাষ্ট্রগুলি যাতে বাংলাদেশকে গিলে খেতে না পারে, সেজন্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা। এই নীতির ফলাফল ভারত হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেতে থাকে ১৯৭২ সাল থেকে।

১৯৭৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩৮টা শহরে কূটনৈতিক মিশন খুলে ফেলেছে। ইউরোপের মস্কো, লন্ডন, প্যারিস, রোম, আমেরিকার ওয়াশিংটন, এশিয়ার বেইজিং, ক্যানবেরা ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের কায়রো, আবুধাবি, কুয়েত, তেহরান, বাগদাদ, ইসলামাবাদ, রিয়াদ, জাকার্তা, কুয়েত, আঙ্কারাতে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন খোলে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, কোন এক দেশের একচ্ছত্র প্রাধান্য সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের উপর ভারতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে; যা কিনা ভারতকে অসন্তুষ্ট করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব-ব্লকের রাষ্ট্রগুলির সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে তা যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তুষ্টির কারণও ছিল। তবে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক কোন একটা দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি। সম্পর্ক এক-দেশ-কেন্দ্রিক না থাকার বহু উদাহরণ নিয়ে আসা যায়। তবে এই লেখাতে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টাকেই তুলে ধরা হয়েছে।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৪টা 'মিগ-২১' ফাইটার বিমান পায়। ১৯৭৩ সালে ‘মিগ-২১’ ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান যুদ্ধবিমান। অর্থাৎ কোয়ালিটির দিক থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হার্ডওয়্যার হয়ে গেলো সমমানের। এই ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমানের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘পি-৩৫’ রাডারও দেয়; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের আকাশসীমায় শত্রু বিমানের উপস্থিতির একটা আগাম বার্তা দেয়া সম্ভব হয় প্রথমবারের মতো। এক ধাক্কায় ঢাকার আকাশ শত্রুর পরিবহণ বিমানের জন্যে ‘নো-ফ্লাই জোন’ হয়ে দাঁড়ায়।


প্রথম দশক - তিনটা ডিটারেন্ট

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন (১৬টা) ‘এফ-৮৬ স্যাবর’ ফাইটার জেটের ব্যাপারে ভারতীয় বিমান বাহিনী কতটা চিন্তিত ছিল, তার উদাহরণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে তেজগাঁও বিমান ঘাঁটির উপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর বারংবার হামলা। দুই দশকের বেশি পুরোনো প্রযুক্তির হলেও এই বিমানগুলি ভারতীয়দের শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি। রানওয়েতে বহু সংখ্যক গভীর খাদ হয়ে যাবার পরেও ভারতীয়রা এই বিমানগুলির ভয়ে ছিল এবং বোমা ফেলা বন্ধ করেনি। ১৬টা বিমানের মাঝে ১৩টা বিমান তেজগাঁও বিমান বন্দরের কম্পাউন্ডের মাঝেই ছিল। এরপরেও তারা সেগুলি খুঁজে পেতেই ব্যর্থ হয়! এর সাথে কমপক্ষে একটা ‘টি-৩৩’ জেট ট্রেইনার বিমানও ছিল। যুদ্ধের শেষে কমপক্ষে ৮টা ‘স্যাবর’ বিমান বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়াররা মেরামত করে সার্ভিসে নিয়ে আসে; যেগুলি ভারতীয়রা ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ প্রথমবারের মতো ঢাকার আকাশে উড়তে দেখে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘এফ-৮৬’ যুদ্ধবিমান ঢাকার আকাশে শত্রু বিমানের প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়; যা খুব বড় কিছু না হলেও গুরুত্বপূর্ণ; যদিও এই বিমানগুলির মেইনটেন্যান্স কতটা নির্ভরযোগ্য ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল তখনও। ভারত বিভিন্ন সময়ে আশেপাশের ছোট দেশগুলির বিমানবন্দরে সামরিক পরিবহণ বিমান নামিয়ে অতি দ্রুত সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। সেসকল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কলহের সুযোগ নিয়ে ভারত এই কাজগুলি করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জে পড়ে যায় ‘এফ-৮৬’ বিমানগুলির জন্যে। এই বিমানগুলির ইউনিটের ব্যাপারে হয় আগে থেকেই নিশ্চিত হতে হবে যে তারা আকাশে উড়ে ভারতীয় পরিবহণ বিমানকে বাধা দেবে না। অথবা ভারতীয় ফাইটার বিমানকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বোমা ফেলে এই বিমানগুলিকে আকাশে ওড়া থেকে বিরত রাখতে হবে। এই কাজগুলি সম্পাদন করাটা কূটনৈতিকভাবে বেশ কঠিন।

তবে এই কাজটা আরও অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায় যখন ১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে পুরো এক স্কোয়াড্রন ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমান (১২টা ‘মিগ-২১এমএফ’ এবং ২টা ‘মিগ-২১উইবি’ ট্রেইনার) উপহার দেয়। এই বিমানগুলির সাথে এসেছিল ৭৫টা ‘কে-১৩এ’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৭৩ সালে ‘মিগ-২১’ ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান যুদ্ধবিমান। অর্থাৎ কোয়ালিটির দিক থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হার্ডওয়্যার হয়ে গেলো সমমানের। এই ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমানের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘পি-৩৫’ রাডারও দেয়; যার মাধ্যমে বাংলাদেশের আকাশসীমায় শত্রু বিমানের উপস্থিতির একটা আগাম বার্তা দেয়া সম্ভব হয় প্রথমবারের মতো। এক ধাক্কায় ঢাকার আকাশ শত্রুর পরিবহণ বিমানের জন্যে ‘নো-ফ্লাই জোন’ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ‘এফ-৮৬ স্যাবর’, ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমান এবং ‘পি-৩৫’ রাডার ছিল বাংলাদেশের প্রথম ডিটারেন্ট। অন্য কথায় বলতে গেলে ১৯৭৪ সাল থেকে ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে হলে স্থলসীমান্ত পেরিয়ে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হবে; যা খুবই কঠিন একটা কাজ হবে। এখন বাংলাদেশ তার সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে পারে; যাতে করে স্থলসীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় আগ্রাসন যেন বিভীষিকাময় হয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার ১৯৭১ সালের তিনটা ব্রিগেডকে তিন স্থানে মোতায়েন করে নিয়মিত সেনাবাহিনীর অংশ করে নেয় - যশোরে ৫৫ ব্রিগেড, ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেড, কুমিল্লাতে ৪৪ ব্রিগেড। কিছুদিনের মাঝে রংপুরেও ৭২তম ব্রিগেড স্থাপন করা হয়। ১৯৭৪ সালের ১১ই জানুয়ারি কুমিল্লাতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন ইউনিট তৈরি করার জন্যে বিরাট একটা মাইলফলক ছিলো। আর ১৯৪৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার তো ছিলোই। প্রায় ২৪ হাজার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। আর যুদ্ধের পর ৩০ হাজারের বেশি বাঙ্গালী সামরিক সদস্যকে পাকিস্তান থেকে ফেরত নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে মিশর ও সিরিয়ার পক্ষ নেয়ায় বাংলাদেশকে উপহারস্বরূপ ৩০টা ‘টি-৫৪’ ট্যাংক দেয় মিশর। এর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রেখে যাওয়া ‘এম-২৪’ ট্যাঙ্কগুলি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাংক ইউনিট গঠনের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু এই ‘টি-৫৪’ ট্যাঙ্কগুলি সেনাবাহিনীর আর্মার্ড কোরের ভিত গড়ে দেয়। ইতালি থেকে ‘অটো মেলারা মড-৫৬’ ডিজাইনের ১০৫মিঃমিঃ আর্টিলারি হাউইটজার আনা শুরু হয়। ‘সিপরি’র হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোট ৮৫টা কামান পেয়েছিল। এর মাধ্যমে আর্টিলারি কোর একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ায়। এই কর্মকান্ডগুলি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যাকে দ্রুত বৃদ্ধি করে এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার জন্যে দ্বিতীয় ডিটারেন্ট তৈরি করে।

তৃতীয় ডিটারেন্ট তৈরি হয় ব্রিটেন ও চীনের হাত ধরে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২এর মাঝে ব্রিটিশ রয়াল নেভি তাদের বাহিনী থেকে রিটায়ার করাটা তিনটা ফ্রিগেট (একটা ‘টাইপ-৪১’, দু’টা ‘টাইপ-৬১’) বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হাতে সল্প পাল্লার ‘ব্লু-ওয়াটার’ সক্ষমতা হাজির হয়। এই ফ্রিগেটগুলিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এমন কিছু ইউনিট গঠন করতে পারবে, যা কিনা শত্রুর নৌ-অবরোধকে কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। সেই হিসেবে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় চীনে তৈরি ৪টা ‘টাইপ-০২৪’ মিসাইল বোট; সাথে ডেলিভারি পায় ২০টা ‘এসওয়াই-১এ’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলির পাল্লা ছিল ১০০কিঃমিঃএরও বেশি। এখন চট্টগ্রাম বন্দরকে অবরোধ দিতে আসা নৌবহর সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকলো না।

স্বাধীনতার পর এক দশকের মাঝেই বাংলাদেশ তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনটা ডিটারেন্ট গঠন করে। প্রথম ডিটারেন্টের মাধ্যমে ঢাকার বিমানবন্দরে পরিবহণ বিমান নামিয়ে সেনা মোতায়েন প্রায় অসম্ভব করে ফেলা হয় এবং এর মাধ্যেম স্থলসীমানা দিয়ে সেনা আক্রমণকেই একমাত্র অপশন করে ফেলা হয়। দ্বিতীয় ডিটারেন্টের মাধ্যমে স্থলসীমানা দিয়ে আক্রমণকে কিছুটা হলেও কঠিন করে ফেলা হতে থাকে। আর তৃতীয় ডিটারেন্টের মাধ্যমে নৌ-অবরোধকে ক্ষতির মাঝে ফেলে দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি করা হয়। এই তিনটা ডিটারেন্ট তৈরিতে অনেক দেশের সহায়তা লেগেছে; যারা সকলেই নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে; যাদের মাঝে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন, মিশর, ইতালি, এবং আরও অন্যান্য দেশ। স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বাংলাদেশ বহু রাজনৈতিক কলহের মাঝ দিয়ে গিয়েছে; রক্তাক্ত হয়েছে দেশের বহু অঞ্চল। কিন্ত এতো কিছুর মাঝেও এই ডিটারেন্ট তৈরি করা থেমে থাকেনি।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চীনা নির্মিত 'এফ-৭এমবি' ফাইটার। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩এর মাঝে বিমান বাহিনীতে চীনে নির্মিত ৩৬টা ‘এফ-৬’ ফাইটার বিমান যুক্ত হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে পাকিস্তান থেকে আসে আরও ৪০টা সেকেন্ড-হ্যান্ড ‘এফ-৬’ যুদ্ধবিমান। একইসাথে চীন থেকে আসে ২০টা ‘এফ-৭এমবি’ যুদ্ধবিমান এবং ১২টা ‘এ-৫সি’ যুদ্ধবিমান। এই যুদ্ধবিমানগুলি সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে নেয়।


দ্বিতীয় দশক - আরও শক্তিশালী ডিটারেন্ট

১৯৮০এর দশকে এই ডিটারেন্টগুলিকে আরও শক্তিশালী করা চলমান থাকে। ‘সিপরি’র হিসেবে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩এর মাঝে বিমান বাহিনীতে চীনে নির্মিত ৩৬টা ‘এফ-৬’ ফাইটার বিমান যুক্ত হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে পাকিস্তান থেকে আসে আরও ৪০টা সেকেন্ড-হ্যান্ড ‘এফ-৬’ যুদ্ধবিমান। একইসাথে চীন থেকে আসে ২০টা ‘এফ-৭এমবি’ যুদ্ধবিমান এবং ১২টা ‘এ-৫সি’ যুদ্ধবিমান। এই যুদ্ধবিমানগুলি সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে এক লাফে অনেকদূর এগিয়ে নেয়। এ-তো গেলো প্রথম ডিটারেন্ট। দ্বিতীয় ডিটারেন্টের জন্যে সেনাবাহিনীর ইউনিটের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ডিভিশনের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬-এ। ১৯৮৪-৮৫ সালে চীন থেকে আসে দুই হাজার ‘রেড এরো ৭৩’ ট্যাংক-বিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল। এটা ছিল ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম গাইডেড মিসাইল। সোভিয়েত ‘৯এম১৪ মালইউতকা’ মিসাইলের চীনা কপি ছিল এটা। এই মিসাইল ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭২ সালে এবং ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। এবার বাংলাদেশের মাটি ভারতের ট্যাঙ্কের জন্যেও অনিরাপদ হয়ে যায়। তৃতীয় ডিটারেন্টের জন্যে ১৯৮৭-৮৮ সালে চীন থেকে আসে ৪টা ‘টাইপ-০২১’ মিসাইল বোট। ১৯৮৮-৮৯ সালে চীন থেকে নৌবাহিনী পায় ‘টাইপ-০৫৩এইচ’-ক্লাসের গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট বিএনএস ওসমান। এটা ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট। এই জাহাজগুলি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

অর্থাৎ স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে যেখানে তিনটা ডিটারেন্ট তৈরি করা হয়েছিল, সেখানে এর পরের দশকে এই ডিটারেন্টগুলিকে আরও অনেক শক্তিশালী করা হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রায় অসম্ভব করে ফেলা হয়। কাজেই বাংলাদেশের নীতিতে ভারতের প্রভাব বাড়াতে দিল্লীর নীতিতে একটা বড় পরিবর্তন দেখা যেতে থাকে ১৯৮০এর দশকের মাঝে। একারণেই দিল্লীর বাংলাদেশ নীতিতে যুক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই হ্রদ তৈরির পর বিশাল এলাকা পানির নিচে চলে যায়। এর ফলে বহু মানুষ তাদের আবাসস্থল হারিয়ে ফেলে। এই মানুষগুলির মাঝে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলিকে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং আধা-সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে আটকে থাকে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নৌ-অবরোধের চিন্তাটাও জেঁকে বসে। যেকারণে নৌবাহিনীর গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট এবং মিসাইল বোটগুলি গুরুত্বপূর্ণ ডিটারেন্ট হয়ে যায়।

১৯৯০এর দশকের শুরুটাই হয় ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দিয়ে। ঘূর্ণিঝড়ে বিমান বাহিনীর ৪০টার মতো যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংস হয়। শুধুমাত্র দুই সিটের ‘এফটি-৬’ ট্রেইনার বিমানগুলিকে সার্ভিসে রেখে সকল ‘এফ-৬’ বিমানকে মেরামত না করে একযোগে রিটায়ার করিয়ে দেয়া হয়। এই বিমানগুলিকে কখনোই প্রতিস্থাপন করা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহর হঠাৎ করেই অর্ধেক হয়ে যায়।


তৃতীয় দশক - ক্রাইসিস

১৯৯০এর দশকের শুরুটাই হয় ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দিয়ে। ঘূর্ণিঝড়ে বিমান বাহিনীর ৪০টার মতো যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংস হয়। নৌবাহিনীরও কিছু জাহাজ ডুবে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন এক অজানা কারণে ঘূর্ণিঝড়ের আগে জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে এই অতি মূল্যবান সম্পদগুলিকে নিরাপদে সরানো হয়নি। বিমান বাহিনী প্রাথমিকভাবে বলে যে, ক্ষতিগ্রস্ত বিমানগুলির মাঝে কয়েকটা ছাড়া বেশিরভাগই মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু সেবছরই দেখা গেলো যে, শুধুমাত্র দুই সিটের ‘এফটি-৬’ ট্রেইনার বিমানগুলিকে সার্ভিসে রেখে সকল ‘এফ-৬’ বিমানকে মেরামত না করে একযোগে রিটায়ার করিয়ে দেয়া হয়। এই বিমানগুলিকে কখনোই প্রতিস্থাপন করা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহর হঠাৎ করেই অর্ধেক হয়ে যায়। খুব সম্ভবতঃ অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়েই এই বিমানগুলির মেরামত নাকচ করে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৩ সালে সার্ভিসে থাকা শেষ ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমানগুলিকেও রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার প্রথম ডিটারেন্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একারণে ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অত্যাচার ও গণহত্যার মাধ্যমে তাদের রাখাইন প্রদেশ থেকে আড়াই লক্ষ মুসলিমকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশ কিছুই করতে পারেনি। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতির একটা মারাত্মক ব্যর্থতা এটা। এই নীতি ভারতকে ব্যালান্স করতে হয়তো সফল হয়েছে; কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে মার খেয়েছে।

১৯৯০এর দশকে মিয়ানমার ‘এফ-৭’ যুদ্ধবিমান পায়; যেগুলি সংখ্যায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়াও মিয়ানমার চীন থেকে ‘হাউজিন-ক্লাস’এর ৬টা মিসাইল বোট কেনে এবং নিজের দেশেই ‘৫-সিরিজ’এর মিসাইল বোট তৈরি করা শুরু করে। নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যার দিক থেকেও মিয়ানমার বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যায় দ্রুতই। মোটকথা, বাংলাদেশ যে মিয়ানমারকে তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে কখনোই হুমকি মনে করেনি, সেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীই এখন সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের ডিটারেন্টগুলিকে নাকচ করে দেয়ার চেষ্টায় নেমেছে। বাংলাদেশের সামনে তার ডিটারেন্ট ফিরে পাবার একটাই উপায় থাকে - কোয়ালিটি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৮টা ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমান কেনে। একইসাথে ২০০১ সালে দক্ষিণ কোরিয়াতে তৈরি করা অত্যাধুনিক ফ্রিগেট বিএনএস বঙ্গবন্ধুর ডেলিভারি পায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। কিন্তু মিয়ানমারও বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। ২০০১ সালেই মিয়ানমার বেলারুশ থেকে ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমান কেনে; এবং সেটাও আবার সংখ্যায় বাংলাদেশের চাইতে বেশি। মাত্র এক দশকের মাঝে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়ায় মিয়ানমার। বলাই বাহুল্য যে, দিল্লীতে কেউ এতে অখুশি হবার কথা নয়। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের এই অস্ত্র প্রতিযোগিতাই পরবর্তীতে দিল্লীর বাংলাদেশ নীতিকে আরও একবার পরিবর্তন করতে সহায়তা করে।

চতুর্থ দশক - হিসেব নিকেশ

প্রায় ২০০১ সাল থেকে চীন এবং ভারতের অর্থনীতি ব্যাপক গতি পেতে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এই দুই দেশের সাথে গতি পেতে থাকে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৩২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০০০ সালে তা ৫৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সাল নাগাদ তা একেবারে দ্বিগুণ হয়ে ১১৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক অবকাঠামোর নিরাপত্তা দেয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি নিরাপত্তার পেছনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এরপরেও প্রথম ডিটারেন্ট নিগৃহীতই থেকে যায়। রাশিয়া থেকে দু’টা ‘১এল-১১৭’ রাডার কেনা হয় ২০০১ সালে। ২০০৬ সালে ১৬টা ‘এফ-৭বিজি’ যুদ্ধবিমান কেনা হয় চীন থেকে। তবে এগুলি প্রথম ডিটারেন্টকে বিশেষ কোন সুবিধা দিতে পারেনি।

প্রথম ডিটারেন্ট দুর্বল হবার সাথেসাথে দ্বিতীয় ডিটারেন্টের উপরও চাপ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় ডিটারেন্ট হিসেবে শত্রুর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ চালাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মেকানাইজড ইউনিট গঠনের কাজ শুরু করে এই সময়ে। রাশিয়া থেকে ১৩০টার মতো ‘বিটিআর-৮০’ এপিসি কেনা হয়। চীন থেকে আড়াই’শ ‘কিউডব্লিউ-২’ অতি-স্বল্প পাল্লার বিমান-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কেনা হয়। রাজনৈতিক কারণে নৌবাহিনীর ডিকমিশন করা যুদ্ধজাহাজ বিএনএস বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় ডিটারেন্ট হিসেবে সার্ভিসে নিয়ে আসা হয়। একইসাথে বিএনএস ওসমানএর ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পরিবর্তন করে ‘সি-৮০২’ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালের নভেম্বরে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের কাছাকাছি মিয়ানমারের সাথে একটা সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় চলে যায় বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের নৌবাহিনী। এই ঘটনায় বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কিছুটা এগিয়ে থাকলেও এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, বাংলাদেশের ডিটারেন্টগুলিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ এখন শুধুমাত্র সার্বভৌমত্ব রক্ষাই নয়, নিজেদের অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলিকে রক্ষা করাটাও একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে যায়। নিজেদের অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলিকে রক্ষা করতে হলে এমন কিছু ডিটারেন্ট প্রয়োজন, যা কিনা শত্রুর অর্থনৈতিক অবকাঠামোকেও হুমকির মাঝে ফেলে দিতে সক্ষম।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর 'অনুশীলন নবদিগন্ত ২০২১-২২-এ প্যারাড্রপিং এক্সারসাইজ। ২০১৬ সালে তৈরি করা হয় প্যারাকমান্ডো ব্রিগেড। এই কমান্ডোদেরকে শত্রুর এলাকার ভেতর মোতায়েন করতে ‘হাই অল্টিটিউড হাই ওপেনিং’ বা ‘হাহো’ এবং ‘হাই অল্টিটিউড লো ওপেনিং’ বা ‘হালো’ প্যারাশুট ডেলিভারির কৌশলগুলি রপ্ত করা শুরু হয় ২০২০এর পর। ‘হাহো’ পদ্ধতিতে প্যারাট্রুপাররা প্রায় ৫০কিঃকিঃ দূর থেকে জাম্প করে গ্লাইড করে টার্গেট এলাকায় অবতরণ করতে পারে। এই পদ্ধতি শত্রুর এলাকার গভীরে হামলা করার জন্যে সবচাইতে উপযোগী।


পঞ্চম ও ষষ্ঠ দশক - চতুর্থ ডিটারেন্টের খোঁজে

প্রথম ডিটারেন্ট ছিল বাংলাদেশের আকাশসীমানাকে শত্রুর সামরিক পরিবহণ বিমানের জন্যে কঠিন করে ফেলা; যাতে করে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে কোন শত্রু সামরিক বিমান সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে না পারে এবং স্থল আক্রমণে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতির পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ৮টা ‘এল-৩৯জেডএ’ এডভান্সড ট্রেইনার, ৮টা ‘মিগ-২৯’, এবং ১৬টা ‘এফ-৭বিজি’। সবগুলি ‘এফ-৬’ এবং ‘মিগ-২১’ প্রায় একসাথে রিটায়ার করিয়ে দেয়ার পর এগুলি দ্বারা প্রথম ডিটারেন্ট কোনমতে টিকে ছিল। দ্বিতীয় ডিটারেন্ট ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেকোন স্থল আক্রমণ দুর্বিসহ করে ফেলা। কিন্তু এটাও দুর্বল হতে শুরু করে যখন নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলিও রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে যায়। নিজের দেশকে ধ্বংস করে শত্রু আটকাবার নীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

একইসাথে ২০১৬ সালে ‘হোলি আর্টিসান’ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ বুঝতে পারে যে, কত পদ্ধতিতে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া যায়। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’এর নাম করে বড় কোন শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ যেন বাস্তবে রূপ না নিতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের সকল কর্তাব্যক্তি এক মুহুর্তের জন্যেও ভুল করে হলেও বলেননি যে, বাংলাদেশের তথাকথি ‘সন্ত্রাসবাদ’এর পিছনে আন্তর্জাতিক ‘সন্ত্রাসী’ কোন সংগঠন জড়িত। এবং যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং, সামরিক বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী ট্রেনিং, বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে ধরপাকড়, ইত্যাদি চলতে থাকলো।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে কে বা কারা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে উধাও হয়ে গেলো। আর এই ছুতোতে মিয়ানমারের পাশবিক সেনাবাহিনী গণহত্যায় নেমে যায়। সাড়ে ১১ লক্ষ মুসলিম শরণার্থী দিয়ে কক্সবাজার ছেয়ে যাবার পর বাংলাদেশ আবারও বুঝতে পারলো যে, ডিটারেন্স কাজে দিচ্ছে না।

বাংলাদেশের তৃতীয় ডিটারেন্ট ছিল শত্রুর নৌ-অবরোধকে হুমকির মাঝে ফেলে দেয়া। এটাও দুর্বল হতে শুরু করে মিয়ানমারের নৌশক্তি বৃদ্ধি করার সাথেসাথে। কারণ বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক যত খারাপ হতে থাকে, মিয়ানমারও ততটাই দ্রুতবেগে তাদের নৌবাহিনী ডেভেলপ করতে থাকে। এবার বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা চিন্তা করতে থাকলেন যে, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় প্রয়োজন নতুন ডিটারেন্ট; যা হলো - শত্রু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হামলা করে তার সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনার ক্ষতিসাধন। 

শত্রু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হামলার একটা পদ্ধতি হলো স্পেশাল ফোর্স। পুরো ১৯৮০এর দশক চলে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সকে সংগঠিত করতে। ১৯৯২ সালের জুনে সেনাবাহিনীর ১ম প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়ন যাত্রা শুরু করে। ২য় প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়ন তৈরি হতে চলে যায় ২০১৯। আর ২০১৬ সালে তৈরি করা হয় প্যারাকমান্ডো ব্রিগেড। এই কমান্ডোদেরকে শত্রুর এলাকার ভেতর মোতায়েন করতে ‘হাই অল্টিটিউড হাই ওপেনিং’ বা ‘হাহো’ এবং ‘হাই অল্টিটিউড লো ওপেনিং’ বা ‘হালো’ প্যারাশুট ডেলিভারির কৌশলগুলি রপ্ত করা শুরু হয় ২০২০এর পর। যুক্তরাষ্ট্র হয় এই প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণের উৎস। ‘হালো’ পদ্ধতিতে সৈন্যরা ৫ হাজার ফুট থেকে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় বিমান থেকে প্যারা জাম্প দেয়; যেখানে সাধারণ প্যারা জাম্প দেড় হাজার ফুটের মতো হয়ে থাকে। এর ফলে প্যারাট্রুপার বহণকারী বিমান বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্রের পাল্লার ভিতরে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। আর ‘হাহো’ পদ্ধতিতে প্যারাট্রুপাররা প্রায় ৫০কিঃকিঃ দূর থেকে জাম্প করে গ্লাইড করে টার্গেট এলাকায় অবতরণ করতে পারে। এই পদ্ধতি শত্রুর এলাকার গভীরে হামলা করার জন্যে সবচাইতে উপযোগী।

প্যারাকমান্ডো ছাড়াও ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নৌবাহিনীর অধীনে তৈরি করা হয় ‘স্পেশাল ওয়ারফেয়ার এন্ড ডাইভিং স্যালভেজ’ বা ‘সোয়াডস’। কাজেই এই দুই বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সক্ষমতা তৈরি হয় জলে-স্থলে শত্রুর অভ্যন্তরে হামলা করার। নৌবাহিনীর ‘সোয়াডস’ সদস্যদেরকে শত্রুর উপকূলে নামানোর প্রধান বাহণ হয়ে দাঁড়ায় ২০১৬ সালে চীন থেকে কেনা দু’টা ‘টাইপ-০৩৫জি’ সাবমেরিন। সাবমেরিন খুব সন্তর্পণে শত্রুর উপকূলের কাছাকাছি স্পেশাল ফোর্সের সেনাদের নামিয়ে দিতে পারে; যাতে তারা শত্রু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনা ধ্বংস করতে পারে, অথবা নিজেদের যুদ্ধবিমান বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে টার্গেট খুঁজে দিতে পারে। সাবমেরিন দু’টা কেনার সিদ্ধান্ত প্রকাশ হবার সাথেসাথেই দিল্লীতে হৈ চৈ পড়ে যায়। এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন পাবার তিন বছরের মাঝেই ভারত নিজেদের একটা রুশ নির্মিত ‘কিলো-ক্লাস’এর সাবমেরিন রিটায়ার করিয়ে মিয়ানমারকে দিয়ে দেয়।

মিয়ানমারের নৌবাহিনী থেকে এগিয়ে থাকতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সাবমেরিন ছাড়াও ৬টা ফ্রিগেট, ৬টা কর্ভেট, ৪টা এলপিসি জোগাড় করে। কিন্তু মিয়ানমারও বাংলাদেশের সমান্তরালেই নিজেদের নৌবাহিনী ডেভেলপ করতে থাকে; কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েও যায়। ভারত মিয়ানমার নৌবাহিনীকে এক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা দিতে থাকে। আর মিয়ানমারের বিমান বাহিনী পাকিস্তান থেকে ‘জেএফ-১৭’ যুদ্ধবিমান, রাশিয়া থেকে ‘মিগ-২৯’, ‘সুখোই-৩০’ এবং ‘ইয়াক-১৩০’ যুদ্ধবিমান, এবং চীন থেকে ‘এফটিসি-২০০০’ যুদ্ধবিমান কেনে। ‘জেএফ-১৭’ যুদ্ধবিমানগুলিকে জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রেও সজ্জিত করা হয়; যাতে করে সেগুলি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে হুমকিরূপে দেখা দেয়। মোটকথা বাংলাদেশের প্রথম ডিটারেন্ট বিমান বাহিনী এবং তৃতীয় ডিটারেন্ট নৌবাহিনী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মিয়ানমারের কারণে। চতুর্থ ডিটারেন্ট হিসেবে স্পেশাল ফোর্সকে ডেভেলপ করা হলেও এক্ষেত্রে সাবমেরিনের ভূমিকা অনেক বড় আকারে দেখা দেয়। কিন্তু সেটার সক্ষমতাকেও ভারত কমিয়ে ফেলে মিয়ানমারকে সাবমেরিন এবং মিয়ানমার নৌবাহিনীর ফ্রিগেটগুলির জন্যে সাবমেরিন-ধ্বংসী সোনার এবং টর্পেডো সরবরাহ করার মাধ্যমে। এবারে চতুর্থ ডিটারেন্টের জন্যে বাংলাদেশ তার বিমান বাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করতে থাকে।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় রুশ লীড-ইন-ট্রেইনার বিমান ‘ইয়াক-১৩০’। এই বিমানটা প্রযুক্তিগত দিক থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সবচাইতে উন্নত বিমান। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ভাষ্যমতে, ‘ইয়াক-১৩০’ বিমানের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রাতের বেলায় আকাশ থেকে শত্রুর উপর হামলা করার সক্ষমতা অর্জন করে। ‘ইয়াক-১৩০’ বিমান প্রায় ১৫কিঃমিঃ দূর থেকে ৫০০কেজি ওজনের 'কেএবি-৫০০কেআর' টিভি-গাইডেড বোমা শত্রুর টার্গেটের ১৩ফুট থেকে ২৩ফুটের মাঝে ফেলতে সক্ষম।


চতুর্থ ডিটারেন্ট - বিমান বাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইক মিশন

১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে চার দশকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর শত্রুর উপর আক্রমণ করার সক্ষমতা ছিল। তবে সেই আক্রমণে স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত কোন সামরিক বা অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস করার সক্ষমতা ছিল সীমিত। কারণ শুধু রকেট বা সাধারণ বোমা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট টার্গেট ধ্বংস করা খুব সহজ নয়। কারণ একদিকে যেমন নিখুঁতভাবে রকেট বা বোমা নিক্ষেপ কঠিন, তেমনি খুব কাছে থেকে গোলা নিক্ষেপ করা পাইলটের জন্যে খুবই বিপজ্জনক। বিশেষ করে সেই টার্গেটের আশেপাশে যদি শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে। শত্রুর অঞ্চলের ভেতরে ঢুকে বেশ দূর থেকেই এধরণের টার্গেটে হামলা করে ফিরে আসতে পারার জন্যে কোন অস্ত্র বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কাছে ছিল না। তবে কিছু অস্ত্র বিমান বাহিনীর কাছে ছিলো, যা দিয়ে নির্দিষ্ট ধরণের কিছু শক্তিশালী টার্গেট ধ্বংস করা সম্ভব ছিল। যেমন, ‘এফ-৭’ সিরিজের বিমানগুলি ২০০কেজি ওজনের ‘টাইপ-২০০এ’ এন্টি-রানওয়ে বোমা এবং ক্লাস্টার বোমা বহণ করতে পারতো। আর ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলি ১২৩কেজি ওজনের ‘এস-২৪’ ২৪০মিঃমিঃ রকেট বহণ করতে পারতো।

২০১০এর পর বিমান বাহিনীতে ১৬টা ‘এফ-৭বিজি১’ ফাইটার, ১৬টা ‘ইয়াক-১৩০’ লীড-ইন-জেট-ট্রেইনার যুক্ত হয়। এছাড়াও বিমান এবং সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয় ‘এমএম-৯০’ স্বল্পপাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই সংখ্যাগুলি একদিনে যেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়; আবার শুধুমাত্র বিমানের সংখ্যা দিয়েও এখন আর নিজেদের ডিটারেন্ট ধরে রাখা সম্ভব নয়। একারণেই ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ‘এফ-৭বিজি১’ বিমানগুলির জন্যে চীন থেকে ‘এলএস-৬’ জিপিএস-গাইডেড গ্লাইড বোমা কেনে। প্রকৃতপক্ষে এটা কিছু যন্ত্রাংশ, যা কিনা সাধারণ ২৫০কেজি বোমার সাথে জুড়ে দিয়ে সেটাকে প্রায় ৬০কিঃমিঃ দূর থেকে টার্গেটের ৫০ফুটের মাঝে ফেলার জন্যে উপযোগী করে ফেলা হয়। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ বিমান বাহিনী শত্রুর কৌশলগত কোন টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষমতা অর্জন করে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র ৩৫তম স্কোয়াড্রনের ‘এফ-৭বিজি১’ বিমানগুলিই ‘এলএস-৬’ গাইডেড বোমা বহণ করতে পারতো। বিমান বাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদের প্রচেষ্টায় ৫ম স্কোয়াড্রনের ‘এফ-৭বিজি’ বিমানগুলিকেও ‘এলএস-৬’ বহণের উপযোগী করে ফেলেন। এখন দুই স্কোয়াড্রন বিমান এই বোমা বহণ করতে সক্ষম। এই বোমাগুলি যেকোন আবহাওয়ায়, এমনকি মেঘের কারণে ভূমি না দেখা গেলেও টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয় রুশ লীড-ইন-ট্রেইনার বিমান ‘ইয়াক-১৩০’। এই বিমানটা প্রযুক্তিগত দিক থেকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সবচাইতে উন্নত বিমান। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ভাষ্যমতে, ‘ইয়াক-১৩০’ বিমানের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রাতের বেলায় আকাশ থেকে শত্রুর উপর হামলা করার সক্ষমতা অর্জন করে। এই বিমানের সাথেই আসে ‘কেএবি-৫০০কেআর’ টিভি-গাইডেড বোমার ট্রেনিং ভার্সন। ‘ইয়াক-১৩০’ বিমান প্রায় ১৫কিঃমিঃ দূর থেকে ৫০০কেজি ওজনের এই বোমা শত্রুর টার্গেটের ১৩ফুট থেকে ২৩ফুটের মাঝে ফেলতে সক্ষম। এই বোমাগুলি ডেলিভারির জন্যে ভালো আবহাওয়া আবশ্যক। তবে অপটিক্যাল গ্যাইড্যান্সের কারণে এটাকে জ্যামিং করা অসম্ভব।

তুর্কি মিডিয়া বলছে যে, ২০১৯ সাল থেকে তুর্কিরা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭’ বিমানে ‘রকেটসান’ কোম্পানির ‘তেবার’ লেজার-গাইডেড বোমা সংযোজনের চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। এই বিমানগুলি লেজার-গাইডেড বোমা ডেলিভারির জন্যে তৈরি করা হয়নি। তবে তুর্কি ইঞ্জিনিয়াররা কিছু ইকুইপমেন্ট কিট সংযোজনের মাধ্যমে এই বিমানগুলিকে ‘তেবার’ গাইডেড বোমা বহণে সক্ষম করে ফেলেন। এরপর ২০২২এর জানুয়ারি মাসে তুর্কি মিডিয়া আবারও খবর দেয় যে, তুর্কিরা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে ‘তেবার’ লেজার-গাইডেড বোমা সরবরাহ করেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘এফ-৭’ যুদ্ধবিমানগুলি চলমান টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম হলো। এই বোমাগুলি ২ থেকে ২৮কিঃমিঃ দূরত্ব রেখেই ছোঁড়া যায় এবং এগুলি টার্গেটের ১০ফুটের ভেতর আঘাত করতে সক্ষম। অর্থাৎ টার্গেটের বেঁচে যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই। বোমাগুলির টার্গেটিংএর জন্যে অন্য কোন বিমান বা ড্রোন অথবা ভূমিতে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের সহায়তায় টার্গেটের উপর লেজার পয়েন্টার ব্যবহার করতে হয়। উপরে বর্ণিত সেনা ও নৌবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা একারণে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বেলারুশ থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমানগুলি ওভারহলিং এবং মডার্নাইজ করে নিয়ে আসার পর এই বিমানগুলির সক্ষমতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালের বিজয় দিবস প্যারেডে বিমান বাহিনী অফিশিয়ালি ঘোষণা দেয় যে, মডার্নাইজ করার পর এই বিমানগুলি এখন ‘কেএবি-৫০০কেআর’ টিভি-গাইডেড বোমা ব্যবহার করে ২৫কিঃমিঃ দূরের টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম। একইসাথে ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলি এখন ‘কেএইচ-২৯’ এবং ‘কেএইচ’৩১’ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে সক্ষম। ‘কেএইচ-২৯টি’ বিশাল একটা টিভি-গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র। ৬৮৫কেজি ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্রে রয়েছে ৩২০কেজি ওজনের বিশাল একটা ওয়ারহেড; যা কিনা ভূমির যে কোন টার্গেট অথবা সমুদ্রে সবচাইতে বড় আকৃতির যুদ্ধজাহাজ সুপারসনিক গতিতে উড়ে গিয়ে ১৩কিঃমিঃ দূর থেকে ধ্বংস করতে পারে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ম্যারিটাইম এলাকার নিরাপত্তায় ব্যবহার করতে চায়। এই ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘কেএইচ’৩১এ’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ৬১০কেজি ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্র ৯৪কেজি ওজনের ওয়ারহেড ব্যবহার করে ৭০কিঃমিঃ দূর থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন আকৃতির যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করতে সক্ষম। এর সুপারসনিক গতির কারণে জাহাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যে এটা বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। ‘মিগ-২৯’ বিমানগুলি বঙ্গোপসাগরের যে কোন প্রান্তে উড়ে যেতে সক্ষম। আর এই বিমানগুলিতে এধরণের ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করার অর্থ হলো, পুরো বঙ্গোপসাগরের কোথাও কোন জাহাজ বা উপকূলীয় স্থাপনা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে নিরাপদ নয়।

বিমান বাহিনীর এই প্রতিটা স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রাইকে শত্রু এলাকার অনেক ভেতরে মিশন পরিচালনা করতে হবে; যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পাইলট ভূপাতিত হতে পারে। এমতাবস্থায় এই পাইলটকে উদ্ধার করাটা জরুরি; কেননা একটা বিমান স্বল্প সময়ে কিনে নিয়ে আসা সম্ভব হলেও একজন অভিজ্ঞ পাইলট তৈরি করতে অনেক বছর সময় লাগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানির প্রচুর ভালো ভালো বিমান ছিল (জেট ফাইটার সহ); কিন্তু অভিজ্ঞ পাইলটের অভাবে তারা আকাশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। একারণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তাদের চতুর্থ ডিটারেন্ট ডেভেলপ করার সাথে সাথে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা থেকে পাইলট উদ্ধার করার মিশন নিয়ে অনুশীলন শুরু করে। ‘কমব্যাট সার্চ এন্ড রেসকিউ’ বা ‘সি-এসএআর’ মিশনের জন্যে ‘আগুস্টা এডব্লিউ-১৩৯’ উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার এবং ‘এমআই-১৭১এসএইচ’ হেলিকপ্টার ক্রয় করার ছাড়াও এই মিশনের কার্যপ্রণালী কেমন হওয়া উচিৎ, তার উপরে নিয়মিত চলছে কনসেপ্ট ডেভেলপমেন্ট এবং প্রশিক্ষণ। বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে থাকে নিজস্ব স্পেশাল ফোর্স; যারা ‘সি-এসএআর’ মিশনে পাইলট উদ্ধারে মূল ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তুরস্কে নির্মিত 'টিআরজি-৩০০ টাইগার' ৩০০মিঃমিঃ রকেটের পরীক্ষামূলক ফায়ারিং। পৃথিবীর অনেক স্থানে ১২০কিঃমিঃ তেমন কোন পাল্লা নয়; কিন্তু বাংলাদেশের আশেপাশের এলাকার জন্যে এটা অনেক। কারণ এই এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে কিছুদূর পরপরই বড় বড় শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো রয়েছে। তবে এ-ই শেষ নয়। কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৮০কিঃমিঃ পাল্লার ‘টাইপ-এ’ ক্ষেপণাস্ত্রও পাবার পথে রয়েছে; যা আরও বহু এলাকা বাংলাদেশের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাঝে নিয়ে আসবে।


চতুর্থ ডিটারেন্ট - সেনাবাহিনীর রকেট আর্টিলারি

২০১৯ সালের মার্চে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তুরস্ক থেকে মধ্যম পাল্লার ‘টাইপ-বি’ রকেট লঞ্চার কেনার চুক্তি করে। তুরস্কের ‘রকেটসান’ কোম্পানির তৈরি ৩০০মিঃমিঃ ক্যালিবারের ‘টিআরজি-৩০০ টাইগার’ মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমকে স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল বলাটাই শ্রেয়। কারণ এই ক্ষেপণাস্ত্রের ১০৫কেজি ওয়ারহেড স্যাটেলাইট এবং ইনারশিয়াল ন্যাভিগেশন ব্যবহার করে ১২০কিঃমিঃ দূরের লক্ষ্যবস্তুর ১০ফুটের মাঝে আঘাত হানতে সক্ষম। ২০২১ সালের ৩০মে এই ক্ষেপণাস্ত্রের চালান পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী; যা অফিশিয়ালি ‘স্ট্রাটেজিক ওয়েপন সিস্টেম’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর অনেক স্থানে ১২০কিঃমিঃ তেমন কোন পাল্লা নয়; কিন্তু বাংলাদেশের আশেপাশের এলাকার জন্যে এটা অনেক। কারণ এই এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে কিছুদূর পরপরই বড় বড় শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো রয়েছে। তবে এ-ই শেষ নয়। কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৮০কিঃমিঃ পাল্লার ‘টাইপ-এ’ ক্ষেপণাস্ত্রও পাবার পথে রয়েছে; যা আরও বহু এলাকা বাংলাদেশের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাঝে নিয়ে আসবে।

তবে এত দূরের টার্গেটে নিখুঁতভাবে গোলা ছুঁড়তে গেলে টার্গেট খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স ছাড়াও সেনা ও বিমান বাহিনীর ড্রোনগুলি এই ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে টার্গেট খুঁজে দিতে সক্ষম। বিমান বাহিনীর ইতালিতে তৈরি ‘ফ্যালকো আস্টোর’ ড্রোন এবং সেনাবাহিনীর তুরস্কে তৈরি ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনের ‘হেনসোল্ড আরগোস-২’ ইলেকট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর দ্বারা ২০০কিঃমিঃ থেকে ৩০০কিঃমিঃ দূরত্বে ভূমিতে লুকিয়ে রাখা যেকোন কৌশলগত সামরিক স্থাপনার লোকেশন নিখুঁতভাবে সনাক্তকরণ সম্ভব। এই লোকেশনের তথ্য ‘এফ-৭’ বিমানের ‘এলএস-৬’ গাইডেড বোমা অথবা ‘টিআরজি-৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্রের গাইড্যান্স সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিলেই সেই টার্গেট ধ্বংস করার মিশন পরিচালনা করা সম্ভব।

যে ব্যাপারটা একমত হতেই হবে তা হলো, পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের নীতির প্রকৃতপক্ষে কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ এই রাষ্ট্রের চিন্তার ভিত একই আছে; যা ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের এঁকে দেয়া বাউন্ডারির প্রতিফলন। বহু সরকার আসা-যাওয়া করলেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি একই রয়েছে; যাদের চিন্তায় পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশে পাঁচ দশকে যা কিছু ঘটেছে, তার কেন্দ্রে সর্বদাই রয়েছে রাষ্ট্রের স্থায়ী সংস্থাগুলি। এটা একটা স্থায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামো; যা ১৯৪৭-কেন্ত্রিক চিন্তাকে ঘিরে আবর্তিত। বাংলাদেশে যেকোন পরিবর্তনও এই স্থায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কেন্দ্র করেই হতে হবে; সেটা ১৯৪৭কে মাথায় রেখেই হোক, অথবা ১৯৪৭কে উপেক্ষা করেই হোক।


পাঁচ দশক ধরে কেন বাংলাদেশ শুধু ডিটারেন্সের পিছনেই ছুটছে?

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙ্গে দেয়ার সময় ব্রিটিশরাই ঠিক করেছে এখানে কয়টা রাষ্ট্র হবে, সেগুলির মানচিত্র কেমন হবে এবং এই রাষ্ট্রগুলির গঠনতন্ত্রই বা কেমন হবে। ব্রিটিশরা নিশ্চিত করেছে যে, উপমহাদেশে নতুন তৈরি করা রাষ্ট্রগুলির মাঝে থাকবে দ্বন্দ্ব এবং একে অপরকে দেখবে তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে। কারণ এই রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বের সংজ্ঞাটাও ব্রিটিশরা এমনভাবেই দিয়েছে, যাতে করে তারা সারাক্ষণ একে অপরকে নিজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, ব্রিটিশরা বোঝেনি যে কোন একসময় পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। বরং ব্রিটিশদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভেঙ্গে যাওয়া পাকিস্তানের অংশগুলি ব্রিটিশ চিন্তার উপর ভর করেই চলবে কিনা। একারণেই ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ভেঙ্গে ফেলার প্রায় ২৫ বছর পর বাংলাদেশের জন্ম হলেও বাংলাদেশের চিন্তাটা সেই একই অস্তিত্বের চিন্তার আশেপাশে ঘুরপাক খেয়েছে।

১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল নিজের অস্বিত্ব রক্ষা করা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের এঁকে দেয়া বাউন্ডারি ১৯৭২ সালেও বাংলাদেশের জন্যে ছিল সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। তিন দিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে রাখা বিশাল রাষ্ট্র ভারত ছিল বাংলাদেশের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে; কারণ ১৯৪৭ সালের মানচিত্র এটাই ঠিক করে দিয়েছিল। প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ ভারতের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে সারা বিশ্বে বন্ধু খুঁজেছে; এমনকি পাকিস্তানের সাথেও সম্পর্কোন্নয়ন করতে তার সময় লাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের সাথেই বন্ধুত্ব রেখেছে সে ব্যালান্সিং এক্ট হিসেবেই; যাতে কোন একজনের পকেটে তারা চলে না যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা চেয়েছে শক্তিশালী দেশগুলিকে খুশি রাখতে; যাতে করে তারা নাখোশ হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিছু করে না বসে। কিন্তু সকলকে খুশি করাটা একটা অবাস্তব ব্যাপার; যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্তাব্যাক্তিরা প্রথম দিন থেকেই জানতো। তথাপি তারা ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব’র মতো একটা নীতি প্রণয়ন করেছিল। আবার একইসাথে বাস্তবতাকে মাথায় রেখে তারা নাখোশ হওয়া ‘বন্ধু’কে রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে মরিয়া থেকেছে। এটাই হলো বাংলাদেশের ডিটারেন্স খোঁজার উৎস। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বহু সরকার এসেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল নিয়মিত; এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ছিল রক্তাক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের চিন্তার কেন্দ্রে থাকা ডিটারেন্সের নীতি থেকে বাংলাদেশ কখনোই সরে আসেনি। কারণ এই নীতি বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরির সাথে সম্পর্কিত; যেটার উপর বাংলাদেশের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই।

স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বাংলাদেশ তার তিনটা ডিটারেন্স তৈরি করেছে। দ্বিতীয় দশকে সেগুলিকে আরও বহু শক্তিশালী করেছে। কিন্তু তৃতীয় দশকে এই ডিটারেন্স ধ্বংস হয়েছে এবং রাষ্ট্র পড়েছে মহা বিপদে। বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকের শক্তিশালী অবস্থান ভারতকে তার নীতির পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়েছে ভারতের জন্যে নতুন ফোকাস পয়েন্ট। তবে একইসাথে তৃতীয় দশকে মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে যাবার পর থেকে ভারত সেটাকে সুযোগ হিসেবেই দেখেছে; যদিও সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ভারতের আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। চতুর্থ দশক চলেছে দুর্বল অবস্থানকে নিয়েই। তবে এসময়ে চলেছে চিন্তাভাবনা এবং নিজেদের ডিটারেন্সগুলিকে পূনরুজ্জীবিত করার নতুন পরিকল্পনা। সেই অনুযায়ী পঞ্চম দশকে শুরু হয় নতুন কর্মকান্ড। কিন্তু বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের দুই দশকের স্থবির নীতিকে উপজীব্য করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের ব্যালান্সিং এক্ট হিসেবে ডেভেলপ করে গেছে ভারত। একারণে ২০১০ সাল থেকে বহু চেষ্টা করেও বাংলাদেশ তার কৌশলগত ডিটারেন্টগুলিকে শক্তিশালী অবস্থানে আনতে পারেনি।

পাঁচ দশকের কৌশলগত ডিটারেন্ট গঠনের প্রয়াস কতটুকু সফল হয়েছে, সেই প্রশ্নে একেক জনের কাছে একেক উত্তর পাওয়া যাবে। তবে যে ব্যাপারটা একমত হতেই হবে তা হলো, পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের নীতির প্রকৃতপক্ষে কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ এই রাষ্ট্রের চিন্তার ভিত একই আছে; যা ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের এঁকে দেয়া বাউন্ডারির প্রতিফলন। বহু সরকার আসা-যাওয়া করলেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি একই রয়েছে; যাদের চিন্তায় পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশে পাঁচ দশকে যা কিছু ঘটেছে, তার কেন্দ্রে সর্বদাই রয়েছে রাষ্ট্রের স্থায়ী সংস্থাগুলি; যাদের মাঝে রয়েছে সামরিক বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ এবং তাদের কাঠামো, কূটনীতিক, একাডেমিক ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন চিন্তাবিদ এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক, প্রভাবশালী ব্যাবসায়ীবৃন্দ এবং তাদের সংগঠন, এবং এর বাইরেও আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সামনে এই মানুষগুলিকে দেখা যায় না; কিন্তু রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে এবং হবে। এটা একটা স্থায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামো; যা ১৯৪৭-কেন্ত্রিক চিন্তাকে ঘিরে আবর্তিত। ১৯৪৭এর ভূতই বাংলাদেশকে চালিয়ে নিচ্ছে; এটা কারুর পছন্দ হোক বা না হোক। বাংলাদেশে যেকোন পরিবর্তনও এই স্থায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কেন্দ্র করেই হতে হবে; সেটা ১৯৪৭কে মাথায় রেখেই হোক, অথবা ১৯৪৭কে উপেক্ষা করেই হোক।





সূত্রঃ


‘SYND 28/03/1972 PRIME MINISTER AND PRESIDENT OF BANGLADESH ATTEND INDEPENDENCE PARADE’ in AP Archive, 21 July 2015 (https://www.youtube.com/watch?v=OaekhWjfCu0)
‘SYND 30/09/72 BANGLADESH AIRFORCE CELEBRATES FIRST ANNIVERSARY’ in AP Archive, 23 July 2015 (https://www.youtube.com/watch?v=aPuGKGznTv0)
‘SYND 13-3-72 INDIAN ARMY CEREMONIAL WITHDRAWAL OF BANGLADESH’ in AP Archive, 21 July 2015 (https://www.youtube.com/watch?v=X4D7y2UWQTE)
‘SYND 27/3/1973 2ND INDEPENDANCE DAY MILITARY PARADE’ in AP Archive, 21 July 2015 (https://www.youtube.com/watch?v=b9fDZECQfwY)
‘TRADE REGISTERS’ in Stockholm International Peace Research Institute (SIPRI), (https://armstrade.sipri.org/armstrade/page/trade_register.php)
‘Blood Telegram: India’s Secret War in East Pakistan’ by Gary J Bass, 2014
‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী - ইতিহাসের পুনর্পাঠ’, আলতাফ পারভেজ, ২০১৫
‘Bangladesh Liberation War - Myths and Facts - How India, US, China, and the USSR Shaped the Outcome’ by B. Z. Khasru, 2010
‘RAW: A History of India’s Covert Operations’, by Yatish Yadav, 2020
‘Eagles Over Bangladesh: The Indian Air Force in the 1971 Liberation War’, by P.V.S. Jagan Mohan and Samir Chopra, 2013
‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০২৩ - Bangladesh Army Day 2023’ in ATN News, 20 November 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=fNq432D50uM)
‘A History of Bangladesh, Second Edition’ by Willem van Schendel, 2020
‘Bangladeshi Insurgents Say India Is Supporting Them’ in New York Times, 11 June 1989
‘Bangladesh to probe 50% loss of military aircraft in typhoon’ in Deseret News, 07 May 1991 (https://www.deseret.com/1991/5/7/18919284/bangladesh-to-probe-50-loss-of-military-aircraft-in-typhoon)
‘Bangladesh: Tardy relief work prolongs suffering of populace ravaged by 12-hour cyclone’ in India Today, 31 May 1991 (https://www.indiatoday.in/magazine/special-report/story/19910531-bangladesh-tardy-relief-work-prolongs-suffering-of-populace-ravaged-by-12-hour-cyclone-815365-1991-05-30)
‘Storm Kills 1,000 In Bangladesh’ in The Washington Post, 01 May 1991 (https://www.washingtonpost.com/archive/politics/1991/05/01/storm-kills-1000-in-bangladesh/ca713435-5e43-456d-8759-1fbbfbdcfb85/)
‘GDP (current US$) - Bangladesh’ in The World Bank (https://data.worldbank.org/indicator/NY.GDP.MKTP.CD?locations=BD)
‘Myanmar withdraws warships’ in The Daily Star, 10 November 2008
‘St Martin's Island seen vulnerable’ in The Daily Star, 17 October 2009
‘Bangladesh Attack Is New Evidence That ISIS Has Shifted Its Focus Beyond the Mideast’ in The Ney York Times, 02 July 2016
‘ISIS attack in Bangladesh shows broad reach as ‘caliphate’ feels pressure’ in CNN, 04 July 2016
‘Bangladesh Attack Is New Evidence That ISIS Has Shifted Its Focus Beyond the Mideast’ in The Hindustan Times, 03 July 2016
‘Dozens killed in fighting between Myanmar army and Rohingya militants’ in The Guardian, 25 August 2017
‘Rohingyas in Bangladesh: Myanmar proposes taking them back’ in The Daily Star, 03 October 2017
‘Airborne Systems RA-300 Advanced Ram Air Parachute System’ in Airborne Systems Products (https://airborne-sys.com/products/personnel-parachute-systems/)
‘PM inaugurates Naval Aviation, names SWADS naval command base “Nirvik”’, in Priyo News, 27 December 2011 (http://news.priyo.com/politics/2011/12/27/pm-inaugurates-naval-aviation-44644.html)
‘First 2 submarines commissioned’ in The Daily Star, 12 March 2017
‘Bangladesh can protect itself from any external aggression: PM’ in The Business Standard, 12 December 2021
‘India’s World- Chinese submarines and Sino-Bangladesh defence ties’ in SansadTV, 22 November 2016 (https://www.youtube.com/watch?v=2BOqaLnIZ6s)
‘Why China’s Submarine Deal With Bangladesh Matters’ in The Diplomat, 20 January 2017
‘India set to export torpedoes to Myanmar’ in Times of India, 25 March 2017
‘Why This Indian Neighbour Decided To Buy 2 Submarines From China’ in NDTV, 13 July 2017
‘Defence Make In India: First Batch Of Lightweight Anti-Submarine Shyena Torpedoes Sent To Myanmar’ in Swarajya Magazine, 13 July 2019 (https://swarajyamag.com/insta/defence-make-in-india-first-batch-of-lightweight-anti-submarine-shyena-torpedoes-sent-to-myanmar)
‘India gifts a submarine to Myanmar, gains edge over China’ in The Hindustan Times, 21 October 2020
‘With an eye on China, India gifts submarine to Myanmar’ in Nikkkei Asia, 22 October 2020
‘Roketsan’dan Bangladeş’e TEBER İhracatı ‘ in Savunma Sanayi ST, 18 January 2022 (https://www.savunmasanayist.com/roketsandan-bangladese-teber-ihracati/)
‘জাতীয় প্যারেড স্কয়ার হতে সরাসরি সম্প্রচার’ in BTV, 16 December 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=jIcyKqvbp0I)
‘Kh-29ТЕ Air-to-surface missile’ in Rosoboronexport, 25 September 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=fjoJ1tlmkJo)
‘Kh-31A - Air-launched high-speed anti-ship missile’ in Rosobonexport (http://roe.ru/eng/catalog/aerospace-systems/air-to-air-missile/kh-31a/)
‘Combat Search & Rescue_BAF_2015_xHD’ in @xeehad, 25 May 2015 (https://www.youtube.com/watch?v=DkCs0Cgmq7Y&t=33s)
‘দেখুন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর শীতকালীন মহড়ার দৃশ্য’ in Jamuna TV, 04 May 2020 (https://www.youtube.com/watch?v=XqbqsyFy_9A)
‘সেনাবাহিনীর বহরে যুক্ত হলো তুরস্কের 'টাইগার মিসাইল সিস্টেম' in Somoy TV, 31 January 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=e2NjTcmW8hc&t=9s)

Thursday 19 October 2023

অস্তিত্ব সংকটে ইস্রাইল!

২০শে অক্টোবর ২০২৩

গাজা থেকে রকেট ছোঁড়া হচ্ছে ইস্রাইলের দিকে। সাত দশকেও ইস্রাইলিরা ফিলিস্তিনিদেরকে দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা বুদ্ধিমত্তা, পরিকল্পনা ও কর্মসম্পাদনে ইস্রাইলের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইস্রাইলিদের মাঝে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক - এই সংঘাতের শেষ কি আদৌ সম্ভব? অথবা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলের বিজয় কি আদৌ সম্ভব কিনা?

২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে থাকবে। সেদিন সকালে ফিলিস্তিনিরা গাজা উপত্যকা থেকে বের হয়ে এসে দখলদার ইস্রাইলি বাহিনীর উপর হামলা করে বসে এবং ইস্রাইলের ব্যাপারে বহুদিন ধরে তৈরি করা কল্পকাহিনীগুলিকে মিথ্যা প্রমাণ করে। প্রথম কয়েকদিন ধরে পশ্চিমা মিডিয়াতে হামলার ভিডিওগুলি সম্পূর্ণ দেখানো হচ্ছিলো না; কারণ সেখানে ইস্রাইলি বাহিনীর উপর হামলার পদ্ধতিকে সুন্দরভাবে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। তবে একসময় আরব টিভি চ্যানেলগুলিতে এই ভিডিওগুলি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লে পশ্চিমা মিডিয়াগুলিও ধীরে ধীরে পুরো ভিডিও দেখাতে থাকে। এর মাঝে আবার ইস্রাইল লবির লোকেরা সোশাল মিডিয়াতে এই ভিডিওগুলির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে সেগুলির ছড়িয়ে পড়াকে কিছুটা হলেও আটকাবার চেষ্টা করে। পশ্চিমা মিডিয়া ফিলিস্তিনের এই হামলাকে শুধুমাত্র হামাসের হামলা বললেও যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, এখানে হামাস ছাড়াও পুরো গাজাবাসী জড়িত ছিল। স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া একটা রাজনৈতিক দলের পক্ষে এহেন হামলা সম্ভব ছিল না। কারণ ১৮ই অক্টোবর পর্যন্ত ইস্রাইলি পাশবিক হামলায় সাড়ে ৩ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু ঘটলেও ফিলিস্তিনিদের মাঝে হাল ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি।

হামলার কারণ এবং সময় হিসেবে অনেকেই ধারণা করছেন সৌদি-ইস্রাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া। কারণ সৌদিদের আগে ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলিও ‘আব্রাহাম একর্ড’এর মাধ্যমে মার্কিন মধ্যস্ততায় ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ফেলেছে। একসময় এটা একটা সমঝোতা ছিল যে, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দেবে না। কিন্তু সৌদিরাও যখন ইস্রাইলের সাথে মিলে যাচ্ছিলো, তখন এটা পরিষ্কার হচ্ছিলো যে, আরবরা ফিলিস্তিনকে বিক্রি করে দিয়েছে। হামাস বলছে যে, ফিলিস্তিন সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার টেবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলো। আরও একটা অতিরিক্ত লক্ষ্য হয়তো হামাসের থাকতে পারে; তা হলো, ইস্রাইলের কারাগারে থাকা প্রায় ৬ হাজার রাজবন্দীর মুক্তি; যাদের মাঝে কিছু ব্যক্তিকে ৪০ বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে। হয়তো দু’শ ইস্রাইলি বন্দীর বিনিময়ে তাদেরকে ফেরত পেতে চাইতে পারে হামাস। এর আগে ২০১১ সালে একজন ইস্রাইলি সেনার বিনিময়ে কয়েক’শ ফিলিস্তিনি কয়েদিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ইস্রাইল। এর মূল কারণ হলো ইস্রাইলের সেনাবাহিনী হলো গণবাহিনী; যেখানে পেশাদার সেনার সংখ্যা খুবই কম। বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিতে আসা সেনার পরিবার সর্বদাই আশা করে যে সরকার যুদ্ধবন্দীদের যেকোন মূল্যে ফেরত আনবে। এটা না করলে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকাই দায় হয়ে যাবে।

ব্যর্থ ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স এবং সামরিক বাহিনী

যে ব্যাপার নিশ্চিত তা হলো, হামাসের এই পরিকল্পনা দুই বছরের। ২০২১ সালের মে মাসে গাজা যুদ্ধের সময় হামাস ইস্রাইলের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সক্ষমতার একটা ধারণা করে ফেলে। খুব সম্ভবতঃ তখনই তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, ইস্রাইলকে পরাজিত করা সম্ভব। একারণেই এবারের হামলার শুরুটা হয় ৩০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছোঁড়ার মাধ্যমে; যার বেশিরভাগই ‘আয়রন ডোম’ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। হামাসের সশস্ত্র বিভাগ ‘ইজ্জাদ্দিন আল-কাসাম ব্রিগেড’এর সদস্যরা দুই বছর ধরে ট্রেনিং নিয়েছে। হামাসের ট্রেনিং ভিডিওগুলিতে দেখা যায় যে, তারা ইস্রাইলের লোহার বেড়াগুলি ভেঙ্গে তার মাঝ দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছে এবং শহরাঞ্চলে ঘর থেকে ঘরে হামলা করে শত্রুদের পরাস্ত করার ব্যাপারেও ট্রেনিং নিয়েছে। প্যারা গ্লাইডার ব্যবহার করে দেয়ালের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ইস্রাইলি অঞ্চলে ঢুকে পড়ার ট্রেনিংও ছিল এর মাঝে। হামাসের নেভাল কমান্ডোরা বেশ কয়েক বছর ধরেই ইস্রাইলের উপকূলে ঢুকে পড়ার অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিলো; যেখানে তারা কিছু ক্ষেত্রে সফল বা কিছু ক্ষেত্রে বিফলও হয়েছিল। তবে যে ব্যাপারটা নতুন ছিল তা হলো, কোয়াডকপ্টার ড্রোনের মাধ্যমে ছোট বোমা ফেলে ইস্রাইলি ওয়াচটাওয়ারের উপর গোয়েন্দা ক্যামেরাগুলিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। ৭ই অক্টোবরের হামাসের ভিডিওতে দেখা যায় যে, বিকল করে ফেলা ওয়াচটাওয়ারের দিকে ছুটছে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা; কারণ সেই অঞ্চলে ইস্রাইলিরা কিছু সময়ের জন্যে অন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যা হওয়া অঞ্চলে ছুটে আসা টহলরত ‘মেরকাভা মার্ক-৪’ ট্যাংকের উপর কোয়াডকপ্টার ড্রোন থেকে মর্টার শেল ফেলে সেটাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়। ‘মেরকাভা-৪’এর বর্ম যে উপরের দিকে কতটা দুর্বল, তা এই ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যায়। যেকারণে ইস্রাইল এখন সকল ট্যাঙ্কের উপরে খাঁচা স্থাপন করছে; যাতে করে ট্যাঙ্কগুলিকে ড্রোনের আক্রমণ থেকে বাঁচানো যায়।

সাত দশকেও ইস্রাইলিরা ফিলিস্তিনিদেরকে দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ৭ লক্ষের বেশি ফিলিস্তিনিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর ইস্রাইলিরা মনে করেছিলো যে, ফিলিস্তিনিরা হয় ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যাবে অথবা ইস্রাইলের বশ্যতা স্বীকার করে নেবে; ফিলিস্তিনি ছেলেরা পড়াশোনার অভাবে ও কর্মহীনতায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে। সেটা হয়নি। এরপর ইস্রাইলিরা ফিলিস্তিনি পুরুষদেরকে কারাগারে পুরে মনে করেছিলো যে, ফিলিস্তিনি আন্দোলনের এটাই বুঝি শেষ। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ইন্তিফাদার সময় শিশু এবং মহিলারাও রাস্তায় নেমে ইস্রাইলকে ভুল প্রমাণ করেছিলো। মোসাদ যথারীতি ব্যর্থ ছিলো কোনরূপ আগাম সতর্কতা দিতে। ইস্রাইলিরা গুড়িয়ে দিলো ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর। প্রত্যুত্তরে ফিলিস্তিনিরা হাজির হলো রকেট নিয়ে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদাও হলো ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত; যেখানে চার বছরে এক হাজার ইস্রাইলি প্রাণ হারালো। ইস্রাইলিরা উঁচু দেয়াল তুলে দিলো। জবাবে ফিলিস্তিনিরা দেয়ালের নিচ দিয়ে সুরঙ্গ খুঁড়লো। সাত দশক পর ২০২৩ সালে সবচাইতে বড় হামলা এলো গাজা থেকে। ইস্রাইলের যেকোন শহর এখন রকেটের পাল্লার ভেতরে। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা বুদ্ধিমত্তা, পরিকল্পনা ও কর্মসম্পাদনে ইস্রাইলের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইস্রাইলিদের মাঝে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক - এই সংঘাতের শেষ কি আদৌ সম্ভব? অথবা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলের বিজয় কি আদৌ সম্ভব কিনা?

‘মেরকাভা মার্ক-৪’ ট্যাংকের উপর কোয়াডকপ্টার ড্রোন থেকে মর্টার শেল ফেলে সেটাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়। ‘মেরকাভা-৪’এর বর্ম যে উপরের দিকে কতটা দুর্বল, তা এই ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যায়। ইস্রাইলের দুর্বলতাগুলি আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হামলা প্রমাণ করেছে যে, ইস্রাইল কোন অজেয় শক্তি নয়; যা ইস্রাইলকে নিরাপত্তা দিতে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের মাধ্যমে প্রমাণিত।


ভয় পেয়েছে ইস্রাইলিরা

ইস্রাইলের সরকারি হিসেবে ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত ১৪’শ ইস্রাইলি নিহত হয়েছে। ১৯শে অক্টোবর সকাল পর্যন্ত ৩’শ ৬৩ জন সামরিক এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে। ৩ জন কর্নেলের মাঝে ছিলেন রোই লেভি; যিনি ইস্রাইলের ‘ঘোস্ট ইউনিট’ বলে খ্যাত ‘মাল্টিডোমেইন ইউনিট’ নামের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন। এছাড়াও ৪ জন লেঃ কর্নেল, ২১ জন মেজর, ১৮ জন ক্যাপ্টেন, ১৭ জন লেফটেন্যান্ট ছিল মৃতদের মাঝে। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকে ইস্রাইলিরা তাদের নিজেদের এত মৃতদেহ দেখেনি। ইস্রাইলের ‘হারেতস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বহু ইস্রাইলি ভয়ে প্লেনের টিকেট কেটেছে পালিয়ে যাবার জন্যে। ইস্রাইলে কেউ কেউ হতাশা নিয়ে বলছেন যে, সাত দশকেও এই দেশ তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে পারেনি; এর চাইতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো। ইস্রাইল নিজেকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদীদেরকে ইস্রাইলে এসে বসবাস করার জন্যে অনুপ্রাণিত করেছে সর্বদা। কিন্তু ইস্রাইল প্রতিষ্ঠার সাত দশক পরেও নিরাপত্তাহীনতা অনেকের জন্যেই পীড়াদায়ক ঠেকেছে।

এখানে একটা বড় ব্যাপার ছিল ফিলিস্তিনিদের মরণপণ টিকে থাকার সংগ্রাম। বিত্তশালী এবং সুবিধাভোগী ফিলিস্তিনিরা অনেক আগেই ফিলিস্তিন ছেড়ে পালিয়েছিলো। যারা রয়ে গিয়েছিলো, তাদের বিরুদ্ধেই ইস্রাইলি বাহিনী তাদের বর্বরতাকে টার্গেট করেছিল। ইস্রাইলিরা চাইছিলো যে, ফিলিস্তিনিরা যেন অত্যাচারিত হয়ে তাদের ভূমি ছেড়ে পালিয়ে যায়; তাহলে ইস্রাইল পুরো ভূমির দখল নিতে পারবে। কিন্তু কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি মাটি কামড়ে পড়ে থাকে; ইস্রাইলি হামলায় তাদের পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুবরণ করার পরেও এবং ইস্রাইলিরা তাদের জীবনযাত্রা অস্বাভাবিক রকমের কষ্টকরা করে ফেলার পরেও তারা তাদের ভূমি ছেড়ে যায়নি। ফিলিস্তিন বলতে এখন শুধুই জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর এবং গাজা; বাকি পুরো ফিলিস্তিন এখন ইস্রাইলের দখলে। অস্ত্রের জোরে দখল করে নেয়া এই ভূমিতে ইস্রাইলিরা বসতি স্থাপন করেছে এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের উপর হামলা করলে তারা বলছে যে, ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসী এবং তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব যথারীতি ইস্রাইলকে পুরো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং ইস্রাইলের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দান করছে। তবে আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো, মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ এবং বিরাট সংখ্যক জনগণ এরপরেও পশ্চিমা দেশগুলিকে মানবাধিকার এবং সুবিচারের উদাহরণ হিসেবে দেখছে এবং তাদেরকে বন্ধু মনে করছে।

ইস্রাইলের নিরাপত্তা তার প্রতিবেশীদের হাতে!

তবে ইস্রাইলের নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব তার আশেপাশের আরব দেশগুলির হাতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের বন্ধু এই দেশগুলি বিশাল সামরিক শক্তির মালিক হলেও তারা ইস্রাইলের বিরুদ্ধে সেই শক্তিকে ব্যবহার করবে না নীতিতে এগুচ্ছে। মূলতঃ পশ্চিমাদের ইশারাতেই তাদের এই নীতি। ইস্রাইলের সাথে বন্ধুত্বের পুরষ্কারস্বরূপ মিশর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ এবং ট্যাংক পেয়েছে। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’এর হিসেবে মিশর বিশ্বের ১৪তম শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং ইস্রাইলের তুলনায় মিশরের শক্তি যথেষ্টই বেশি। এর সাথে জর্ডান যোগ হলে ইস্রাইলের জন্যে যেকোন যুদ্ধে জেতা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ইস্রাইল সবগুলি যুদ্ধে জিতেছে - এই ছুতো দেখিয়ে এই দেশগুলির নেতৃত্ব ইস্রাইলের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে। শুধু তা-ই নয়, এবার ফিলিস্তিনি হামলার আগে মিশর ইস্রাইলকে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল বলে খবর বেরিয়ে এসেছে। এতে পরিষ্কার হয় যে, মিশরের সরকার প্রকৃতপক্ষে কাদের বন্ধু। ইস্রাইলের অনুমতি না পেয়ে ১৯শে অক্টোবর পর্যন্ত মিশর গাজার সাথে সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছিল। এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইশারাতেই মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাল এল-সিসি গাজার সীমান্ত খুলে দিতে রাজি হন। অপরদিকে লেবানন এবং জর্ডানে জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ করলে সেই দেশের পুলিশ জনগণের উপর হামলা করে প্রমাণ করে যে, তারা শুধু ইস্রাইলের বন্ধুই নয়, বরং মার্কিনী এবং ইস্রাইলিদের আজ্ঞাবহও বটে।

ইস্রাইল তার নিরাপত্তার জন্যে আশেপাশের দেশগুলির উপর কতটা নির্ভরশীল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইস্রাইলের সেনাবাহিনীর ফর্মেশনের দিকে তাকালে। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর একটা প্লাটুনে রয়েছে মাত্র দু’টা ট্যাংক; যেখানে বাকি দেশগুলিতে ট্যাংক প্লাটুনে রয়েছে ৩ থেকে ৪টা করে ট্যাংক। একটা ট্যাংক কোম্পানিতে যেখানে ১২ থেকে ১৪টা ট্যাংক থাকার কথা, সেখানে ইস্রাইল রেখেছে ১০টা করে। আর একটা ট্যাংক ব্যাটালিয়নে তিনটা কোম্পানির স্থলে ইস্রাইল রেখেছে মাত্র দু’টা। এর ফলে যেখানে বাকি সকল দেশের ট্যাংক ব্যাটালিয়নে ট্যাংক থাকে ৪০ থেকে ৫০টা, সেখানে ইস্রাইলের ট্যাংক ব্যাটালিয়নে ট্যাংক থাকে মাত্র ২২টা। এর কারণ একটাই - হামাস বা হিযবুল্লাহর সাথে যুদ্ধ করতে তো একটা প্লাটুনে দু’টা বা একটা ব্যাটালিয়নে ২২টার বেশি ট্যাংক দরকার হবে না। অর্থাৎ ইস্রাইলের সেনাবাহিনী কোন রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নয়।
 

পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে গাজার সমর্থনে বিক্ষোভে ফিলিস্তিনি পুলিশের রায়ট কারের ধাওয়া। শুধু প্রতিবেশী দেশগুলিই নয়; ইস্রাইল ফিলিস্তিনিদেরকেও বিভক্ত করে রেখেছে, যাতে করে এক ফিলিস্তিনি অন্য ফিলিস্তিনির সহায়তায় এগিয়ে না আসে। ইস্রাইলের এই পরিকল্পনাকে বাস্তবতা দিচ্ছে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন সরকার।

শুধু প্রতিবেশী দেশগুলিই নয়; ইস্রাইল ফিলিস্তিনিদেরকেও বিভক্ত করে রেখেছে, যাতে করে এক ফিলিস্তিনি অন্য ফিলিস্তিনির সহায়তায় এগিয়ে না আসে। একসময় ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টির জনপ্রিয়তাকে বিভক্ত করতে ইস্রাইল হামাসকে উঠতে দিয়েছে। এরপর ২০০০ সালের পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইস্রাইল পশ্চিম তীরে হামাসের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করেছে; যাতে করে পশ্চিম তীরে শুধু ফাতাহ থাকে; আর গাজায় থাকে শুধুই হামাস। মোসাদ এবং সিআইএতে অনেকেই হামাসকে সহায়তা দেয়ার বিরোধী ছিল। তবে ইস্রাইলিরা তাদের নীতি চালিয়ে নেয় ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। ইস্রাইল সর্বদাই ফিলিস্তিনের ইস্যুগুলিকে আলাদাভাবে টেবিলে নিয়ে আসে (যদিও আলোচনার ফলাফল সর্বদাই ছিল শূণ্য); যেমন, আল-আকসা ইস্যু, পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি ইস্যু, সীমানা ইস্যু, গাজা ইস্যু, অথবা অন্য কোন ইস্যু। প্রতিটা ইস্যুতে তারা ভিন্ন পক্ষের সাথে বসেছে এবং ফিলিস্তিনিদের মাঝে বিভেদ তৈরি করেছে। এর ফলশ্রুতিতে এখনও দেখা যায় যে, গাজাতে বোমা ফেলার সময় পশ্চিম তীরে খুব একটা বড় কোন ঘটনা ঘটছে না। ইস্রাইলের এই পরিকল্পনাকে বাস্তবতা দিচ্ছে মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিন সরকার। যেমন, পশ্চিম তীরে গাজার সমর্থনে বিক্ষোভে আব্বাসের পুলিশ বাহিনী হামলা চালিয়েছে।

ইস্রাইলের সেনাবাহিনী কোন পেশাদার বাহিনী নয়

ইস্রাইলের সামরিক বাহিনী মূলতঃ বাধ্যতামূলক সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে গঠিত। সেখানে পেশাদার সেনার সংখ্যা খুবই কম। আর পার্ট-টাইম সেনা হবার কারণেই এই সেনাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে ইস্রাইল এতটা উদগ্রীব। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীই একমাত্র সেনাবাহিনী, যারা ট্যাংক চ্যাসিসের উপর ভিত্তি করে আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার বা এপিসি তৈরি করে। এই এপিসির কাজ হলো শত্রুর গুলি থেকে নিজেদের সেনাদেরকে কিছুটা রক্ষা করা। একারণে বিশ্বের বেশিরভাগ এপিসি মেশিন গানের গোলা ঠেকাতে পারে। তবে এন্টি-ট্যাঙ্ক অস্ত্রের মুখে এগুলি একেবারেই তুচ্ছ। অপরদিকে ইস্রাইলের সেনাবাহিনীতে রয়েছে হেভি এপিসি - ‘আখজারিট’, ‘নাগমাশন’, ‘নাকপাদন’, ‘নামের’। এগুলি ৫২ টন থেকে শুরু করে ৬৪ টন পর্যন্ত ওজনের। এই বর্মাবৃত গাড়িগুলির চেহাড়া দেখলেও বোঝা যায় যে, এর ভেতর বসে থাকা সেনারা নিজেদের জীবন নিয়ে কতটা ভীত।
 

ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর হেভি এপিসি 'নাগমাশন'। ইস্রাইলি সেনাবাহিনীই একমাত্র সেনাবাহিনী, যারা ট্যাংক চ্যাসিসের উপর ভিত্তি করে আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার বা এপিসি তৈরি করে। এগুলি ৫২ টন থেকে শুরু করে ৬৪ টন পর্যন্ত ওজনের। এই বর্মাবৃত গাড়িগুলির চেহাড়া দেখলেও বোঝা যায় যে, এর ভেতর বসে থাকা সেনারা নিজেদের জীবন নিয়ে কতটা ভীত।


ইস্রাইলি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলির সেনাদের অভিজ্ঞতাও প্রশ্ন করার মতো। একেকটা ট্যাংক প্লাটুনে ৮জন করে সেনা থাকে; যাদের মাঝে একজনের অভিজ্ঞতা থাকে সর্বোচ্চ দুই থেকে ৪ বছর। কারণ তারা সেই মুহুর্তে সেনাবাহিনীতে তাদের সার্ভিসের একেবারে শেষের দিকে রয়েছেন। ইস্রাইলের সেনাবাহিনীতে কোন পেশাদার এনসিও নেই, যাদের অভিজ্ঞতা ৩২ মাসের বেশি। অপরদিকে অন্য যেকোন পেশাদার সেনাবাহিনীতে বেশিরভাগ এনসিওর অভিজ্ঞতা ১০ বছর বা এর চাইতে আরও অনেক বেশি হবে। ইস্রাইলের এই সেনাবাহিনীতে আবার রয়েছে রিক্রুটমেন্ট সমস্যা। ইস্রাইলের গোড়া ইহুদি বা হারেদি জনগোষ্ঠী জায়নিস্ট জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয়। তাই তারা সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিতে চায় না। তারা বলে যে, জায়নিস্টরা ইস্রাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সমস্যা তৈরি করেছে; তাই তৈরি করা সমস্যা তাদেরই মেটানো উচিৎ। হারেদিদের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সাল নাগাদ প্রায় ১৩ লক্ষ বা ইস্রাইলের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। এত বড় জনগোষ্ঠীকে সামরিক সার্ভিসের বাইরে রাখতে চাইছে না ইস্রাইল; তাই হারেদিদের সাথে রাষ্ট্রের চলছে দ্বন্দ্ব। রিক্রুটমেন্ট সমস্যা সমাধানে ইস্রাইল ব্যাপক হারে মহিলাদেরকে সামরিক বাহিনীতে নিচ্ছে। কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীতে নিয়মশৃংখলা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ মহিলা সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। পেশাদার সেনাবাহিনী না হওয়ায় এই বাহিনীতে মহিলা সদস্যদের সামরিক যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়। সোশাল মিডিয়াতে ইস্রাইলি মহিলা সামরিক সদস্যদের মুখরোচক পোস্টের বন্যাই এর কারণ।

এর বাইরেও ইস্রাইলের ইহুদি সমাজে রয়েছে ব্যাপক বর্ণবাদ। ইউরোপ থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ ‘আশকেনাজি’ ইহুদিরা মূলতঃ ক্ষমতাধর এবং ধনী। অপরদিকে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অশ্বেতাঙ্গ ‘মিজরাহি’ ইহুদিরা গরীব এবং নিগৃহীত। রাষ্ট্র প্রথম থেকেই ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদেরকে আলাদা সুবিধা দিয়েছে; আর অশ্বেতাঙ্গ ইহুদীদেরকে প্রায় শরণার্থী শিবিরে রাখার মতো করে দেখাশোনা করেছে। সাত দশক একত্রে থাকার পরেও এই দুই গোত্রের ইহুদিদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক কম। জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ এই দুই জনগোষ্ঠীর মিলিত প্রডাক্ট।

ভয় পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও

ইস্রাইলকে সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করেছে; যা কিনা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় না। ইস্রাইলি এবং মার্কিনী বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ইরান এবং হিযবুল্লাহর যুদ্ধে জড়াবার সম্ভাবনা খুবই কম; কারণ তারা কেউই সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কষ্টার্জিত অবস্থানকে জ্বলাঞ্জলি দিতে চায় না। একারণেই তারা চাইছে গাজাতে ইস্রাইলের স্থল হামলা প্রতিরোধ করতে। কারণ স্থল হামলা হলে প্রাণহানি আরও বাড়বে এবং একইসাথে এই দেশগুলির সরকারগুলিও তাদের নিজস্ব জনগণের চাপের মাঝে পড়বে। ইরান এখনও তার পদক্ষেপকে হুমকির উপরেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। আর হিযবুল্লাহ তার দেড় লক্ষ রকেটকে মজুদে রেখে দিয়ে সীমান্তে ইস্রাইলি গোয়েন্দা ক্যামেরাগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে। লেবাননের বাস্তবতাও হিযবুল্লাহর পদক্ষেপকে প্রভাবিত করবে। কারণ লেবানন খুবই বিভক্ত একটা রাষ্ট্র। হিযবুল্লাহ গাজা ইস্যুতে ইস্রাইলের সাথে যুদ্ধে জড়ালে লেবাননের বাকি গ্রুপগুলির সমর্থন তারা না-ও পেতে পারে। কারণ গাজা ইস্যুতে ইস্রাইলের পাল্টা বিমান হামলা নেয়ার মতো মানসিকতা সকলের নেই। ইস্রাইলও কৌশলগত কারণেই একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চাইবে না। তাই তারাও হিযবুল্লাহর সাথে সংঘাতকে সীমান্ত সংঘাতের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবে। কাজেই হিযবুল্লাহ এবং ইরানকে আপাততঃ ইস্রাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র মূল হুমকি মনে করছে না।

ইস্রাইলের গোঁড়া 'হারেদি' ইহুদিরা প্রতিবাদ করছে। তারা জায়নিস্ট জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয়। তাই তারা সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিতে চায় না। তারা বলে যে, জায়নিস্টরা ইস্রাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সমস্যা তৈরি করেছে; তাই তৈরি করা সমস্যা তাদেরই মেটানো উচিৎ। ইস্রাইলের জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ এই 'হারেদি'রা সামরিক সার্ভিসে না আসায় মহিলাদের রিক্রুট করে সেনাবাহিনীর আকার ঠিক রাখা হচ্ছে।
 

যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছে যে, মুসলিম দেশগুলিতে কেউ কেউ তাদের জাতীয়তাবাদকে ভুলে গিয়ে তাদের ফিলিস্তিনি মুসলিম ভাইদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে। অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলির সরকার পশ্চিমাদের আজ্ঞাবহ হলেও এই দেশগুলির সামরিক বাহিনীর কোন অংশ যদি নেতৃত্বের আদেশ অমান্য করে ব্যারাক থেকে বের হয়ে আসে, তাহলে ইস্রাইলের গণবাহিনীর জন্যে মহাবিপদ হাজির হবে। এই সম্ভাবনাকে আটকাতেই যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলে সামরিক সহায়তা পাঠিয়েছে। প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিচ্ছে যে, ইস্রাইলের সামরিক বাহিনী হুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। এটা সত্যিই প্রথম বারের মতো ঘটলো।

মার্কিন চিন্তাবিদেরা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে হামলার পূর্বাভাস দিতে। একইসাথে ইস্রাইলের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে হামাসের পরিকল্পিত আক্রমণকেও অনেকে পেশাদার বাহিনীর কর্মকান্ডের সাথে তুলনা করেছেন। সিআইএর প্রাক্তন একজন ডিরেক্টর ধারণা করছেন যে, ফিলিস্তিনিদের মাঝে মোসাদের এজেন্ট হয়তো ‘কমপ্রোমাইজড’ হয়েছে; অর্থাৎ ধরা পড়ে তথ্যের সোর্স বন্ধ হয়ে গিয়েছে; অথবা ধরা পড়ার পর মোসাদকে ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে। এতে হামাসের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স উইংএর প্রশংসা করতেই হয়। মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন করছেন যে, ইস্রাইল কি নিশ্চিত যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তারা গাজার ভেতর প্রবেশ করবে? ইস্রাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তো বলেছেন যে, তিনি হামাসকে ধ্বংস করবেন। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে সেব্যাপারে তিনি কতটা নিশ্চিত? আবার হামাসের হাতে ফিলিস্তিনিদের যে ‘শ’দুয়েক বন্দী রয়েছে, তাদেরকে কিভাবে উদ্ধার করা হবে? এদেরকে উদ্ধার করাটা কি আরেকটা উদ্দেশ্য হবে? আবার অনেকেই হামাসের সুরঙ্গ নেটওয়ার্কের কথাও বলছেন; যা কিনা ইস্রাইলি বাহিনীর জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সাবেক মার্কিন জেনারেল এবং সিআইএর প্রাক্তন ডিরেক্টর ডেভিড পেট্রেয়াস মনে করছেন যে, হামাসকে ধ্বংস করার আগে চিন্তা করা উচিৎ কাকে দিয়ে হামাসকে প্রতিস্থাপিত করা হবে। কারণ ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিয়েছে যে, একটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধ্বংস করে ফেললে সেখানে নতুন করে আরেকটা নেতৃত্ব তৈরি করাটা বেশ কঠিন কাজ। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ৯-১১এর পর বিভিন্ন দেশে হামলা করে পরবর্তীতে দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইস্রাইলকে এই ব্যাপারগুলি ভাবতে হবে; নাহলে পরবর্তীতে পস্তাতে হবে। মার্কিনীদের এহেন চিন্তাগুলি বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, ইস্রাইল গাজার যুদ্ধকে প্রলম্বিত করুক; বরং দ্রুত সমাধান করে কোন একটা সমঝোতায় আসা যায় কিনা, সেদিকেই হাঁটুক ইস্রাইল। 

ইস্রাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে দেখা করতে ওয়াশিংটন থেকে ছুটে এসেছে বাইডেন। মার্কিনীরা বিপদ বুঝেই আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলতে চাইছে; কারণ চীন ও রাশিয়ার সমান্তরালে আরেকটা ফ্রন্ট খোলার সামর্থ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। একইসাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির নেতৃবৃন্দ পড়েছে বিপাকে। কারণ তাদেরকে ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাওয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় না এই দেশগুলিতে বড় কোন পরিবর্তন আসুক, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।


যখন চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে ব্যাপক সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আরেকটা সমস্যা তৈরি হোক। একসাথে তিনটা এলাকা পাহাড়া দেয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। রাশিয়া এবং চীন এই ইস্যুকে ব্যবহার করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বারংবার ভোটাভুটির আয়োজন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ইস্রাইলের পক্ষে ভেটো প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। ইস্রাইলকে সরাসরি সমর্থন দিতে গিয়ে মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী চিন্তা দানা বাঁধবে এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প কোন ব্যবস্থা খোঁজার ক্ষেত্র প্রশস্ত হবে। শুধু তা-ই নয়, স্বল্প মেয়াদেও তা বাইডেন প্রশাসনের জন্যে সমস্যার। কারণ সামনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন; যার আগে মার্কিন ডেমোক্র্যাট শিবির কোন অবস্থাতেই আরেকটা কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখতে চায় না। অপরদিকে রিপাবলিকান শিবির চাইছে ডেমোক্র্যাটদের ব্যর্থতা প্রমাণ করতে।

ইস্রাইলের দুর্বলতাগুলি আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হামলা প্রমাণ করেছে যে, ইস্রাইল কোন অজেয় শক্তি নয়; যা ইস্রাইলকে নিরাপত্তা দিতে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের মাধ্যমে প্রমাণিত। মার্কিনীরা বিপদ বুঝেই আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলতে চাইছে; কারণ চীন ও রাশিয়ার সমান্তরালে আরেকটা ফ্রন্ট খোলার সামর্থ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। একইসাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির নেতৃবৃন্দ পড়েছে বিপাকে। কারণ তাদেরকে ইস্রাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যাওয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় না এই দেশগুলিতে বড় কোন পরিবর্তন আসুক, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। ২০২১ সালের গাজা যুদ্ধ যেমন প্রমাণ করেছিলো যে, সংঘাত নিরসনে ইস্রাইল আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়েছে; তেমনি ২০২৩ সালের যুদ্ধ প্রমাণ করলো যে, ইস্রাইল সংঘাত নিরসনে যাদের উপর নির্ভর করছে, তারাও তাদের মুসলিম জনগণের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খাচ্ছে। মোটকথা যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল এবং ইস্রাইলের প্রতিবেশী পশ্চিমাদের অনুগত দেশগুলির কেউই মুসলিম ভূখন্ডগুলির বাস্তবিক পরিবর্তনকে না পারছে নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছে এড়িয়ে যেতে। বাস্তবতা হলো, এই গন্তব্য একমুখী। আর এটা একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণকে আরও দুর্বল করছে, তেমনি ইস্রাইলকে অস্তিত্ব সংকটের দিকে ধাবিত করছে।



সূত্রঃ

‘Hamas releases dramatic footage claiming to show dawn raid on Israeli compound’ in The Times, 07 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=FnS9ejxEajo)
‘إنزال جوي .. شاهد القسام توثق مقاطع لوحدة سرب صقر العسكرية المشاركة في معركة طوفانالأقصى’ in Al-ArabyTV, 07 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=AgVUcKpImK0)
‘شاهد .. كتائب القسام تنشر فيديو لمنظومة "رجوم" الصاروخية التي استخدمتها لبدء هجومها علىإسرائيل’ in Al-ArabyTV, 07 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=SIcvYblTttg)
‘Israel war: Hamas used motor-powered hang gliders to infiltrate Israel’ in The Telegraph, 07 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=KF5vPfqtJBM)
‘Hamas Takes Cue From Ukraine War; Blows Up Israeli Tank With Drone-dropped Munition’ in The Hindustan Times, 07 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=ty3eiLGORc4&t=146s)
‘شاهد.. لحظة اقتحام كتائب القسام لموقع عسكري إسرائيلي وقتل وأسر من فيه من جنود’ in Al-ArabyTV, 08 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=bdwiCSyXExw&t=1s)
‘سرايا القدس تعرض مشاهد للاستيلاء على موقع ناحل عوز العسكري شرق غزة’ in Al-Jazeera, 08 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=L60jRdOjyN4)
‘How the Hamas Attack on Israel Unfolded’ in The Wall Street Journal, 08 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=KjhMAMAPgeM&t=1s)
‘Israel-Palestine: How Hamas gunmen broke through the Gaza border’ in The Telegraph, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=B3_yQ4mgOks)
‘Hamas official: 'We have not killed any civilians', in SkyNews, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Egipqa0ZhUk)
‘القسام تعرض مشاهد من تدريبات مقاتلي سلاح الهندسة الذين شاركوا في معركة طوفان الأقصى’ in Al-ArabyTV, 10 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=kO9GN01JVHg)
‘Hamas' New Weapons and Tactics | Project Force’ in Al-Jazeera English, 11 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=nC3pnw54Ro4)
‘مشاهد من تدريبات مقاتلي سلاح الهندسة المشاركين في عملية طوفان الأقصى’ in Al-Jazeera, 11 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=0OwZvqQPqK4)
‘Hamas boasted it could use EU-funded pipelines to attack Israel’ in The Telegraph, 11 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=MvvqBcA-9yA)
‘Why US believes Israel and Saudi Arabia negotiations could be factor in Hamas attacks’ in BBC News, 12 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=22LjM_9hmmA&t=156s)
‘5 أشياء تجعل "طوفان الأقصى" علامة فارقة في تاريخ فلسطين’ in AJ+ Arabic, 10 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=aJ6_1qGD8sE&t=365s)
‘Israel-Hamas war: Could Israel face a two-front problem?’ in SkyNews, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=k33w-EaB_mw)
‘'Absolutely predictable': Analyst on why Hamas attacked Israel’ in CNN, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=1d5bWuCNczE)
‘Prime Minister Netanyahu denies reports that Egypt had warned Israel of Hamas attack’ in CNBC, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=aApFtE6iQWk)
‘'Netanyahu Knew About Hamas' Assault Plan': Israel's Neighbour Drops A Bombshell’ in The Hindustan Times, 11 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=45SYtXnFkqQ)
‘Did Egypt warn Israel about attacks?’ in Fox News, 12 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=I5vEdImeLsc)
‘Retired colonel breaks down 'key indicators' for ground incursion in Gaza’ in CNN, 09 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Uy2qVAHywig)
‘Military expert shows on map where Israeli forces will face challenges in Gaza’ in CNN, 10 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Cy6vewZo3jY)
‘Retired colonel explains how Hamas caught Israel off-guard during attack’ in CNN, 08 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=hjFeFIG4bks)
‘Inside the Hamas ‘Terror Tunnels’ Israel Has Been Bombing’ in VICE News, 08 October 2021 (https://www.youtube.com/watch?v=W4gDfSNMRx4&t=419s)
‘My life as a Palestinian fighter | Close Up’ in Al-Jazeera English, 22 March 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=mSS51ZVhcA0&t=376s)
‘Israel-Hamas war: Israel offensive 'fraught with danger' in SkyNews, 12 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Qc-D-LGosCM&t=27s)
‘The underground tunnels of Gaza: Hamas' tactical advantage’ in Scripps News, 12 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Vvu8R3Lg2wc&t=12s)
‘Ex-CIA director has a warning about a potential 'end result' in Israel-Hamas conflict’ in CNN, 13 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=56hhh0E-wMw&t=163s)
‘شاهد: حماس تنشر فيديو لتدريبات في وضح النهار تحضيراً لهجوم طوفان الأقصى’ in EuroNews Arabic, 13 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=MdZVv9_vBeQ)
‘Blowback: How Israel Helped Create Hamas’ in The Intercept, 20 February 2018 (https://www.youtube.com/watch?v=o7grSsuFSS0&t=6s)
‘Problems with Merkava tank’ in RedEffectChannel, 19 April 2019 (https://www.youtube.com/watch?v=TaD55iDxx3c)
‘Inside Israel’s Weird Tank Units (Merkava)’ in Battle Order, 29 May 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=Rr2qaKt-P3I&t=552s)
‘بعد صاروخ "عياش 250".. "كتائب القسام" تكشف عن قذيفة "الياسين" in Al-Mashhad, 15 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=ibkK6iOptuI)
‘Trey Yingst reveals Hamas weaponry recovered by Israeli military’ in Fox News, 15 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=qGYOdP_2f58)
‘حزب الله يستهدف مدرعات لجيش الاحتلال الإسرائيلي في موقع حانيتا عند الحدود اللبنانيةالفلسطينية’ in Al-ArabyTV, 16 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=hZeUZCElFCM)
‘حزب الله يستهدف مواقع للاحتلال الإسرائيلي على الحدود اللبنانية الفلسطينية’ in Al-ArabyTV, 16 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=LU9uZhodPo0)
‘Hamas Introduces 'Merkava Tank Killer' In War Against Israel; How Made-in-Gaza 'Al-Yassin' Works’ in The Hindustan Times, 16 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=ANczYpLFNxw&t=57s)
‘إصابة مباشرة.. شاهد المقاومة في لبنان تستهدف دبابة ميركافا إسرائيلية بمنطقة الضهيرة’ in Al-ArabyTV, 17 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=I9lSAfOitxs)
‘Hamas seeks Palestinian prisoners' release, calls non-Israeli captives 'guests' in Reuters, 17 October 2023 (https://www.reuters.com/world/middle-east/former-hamas-chief-meshaal-says-israeli-captives-include-high-ranking-officers-2023-10-16/)
‘CNN tours Israeli military base filled with seized Hamas weapons’ in CNN, 18 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=qGFzeKG3_r4&t=43s)
‘'Orders of magnitude more difficult': Petraeus on urban combat’ in CNN, 18 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=RYtxWLVwH_Q)
‘متظاهرون غاضبون يحاولون الوصول للسفارة الإسرائيلية في عمان تنديدا بمجازر إسرائيل في غزة’ in OrientNews, 18 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=LimMR2Z9zHA)
‘شاهد .. الجيش اللبناني يتدخل لفض المظاهرات الغاضبة في محيط السفارة الأميركية’ in Al-ArabyTV, 18 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=iIROFrwd4OY)
‘استهداف كاميرات الجمع الحربي بمواقع إسرائيلية عند الحدود اللبنانية’ in Al-Jazeera, 19 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=LiSkpSNfRK4)
‘الأردن.. مظاهرة حاشدة دعما للفلسطينيين ومطالبة بإلغاء كل الاتفاقيات مع إسرائيل’ in Al-ArabyTV, 19 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=r8ce4DVkHAo)
‘Why Egypt hasn't opened the Rafah crossing with Gaza’ in CBC The National, 18 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=alUO8NX2xUk)
‘Biden says Egypt will open Gaza border crossing to allow humanitarian aid’ in The Guardian, 19 October 2023 (https://www.youtube.com/watch?v=G8BtQjTWwxg)
‘Authorities name 304 soldiers, 57 police officers killed in 2023 terror clashes’ in Times of Israel, updated 18 October 2023 (https://www.timesofisrael.com/authorities-name-44-soldiers-30-police-officers-killed-in-hamas-attack/)
‘Fight Hamas or Flight: The Israelis Fleeing the Country During the War’ in Haaretz, 16 October 2023 (https://www.haaretz.com/israel-news/2023-10-16/ty-article-magazine/.premium/fight-or-flight-after-hamas-attacked-these-israelis-fled-the-country/0000018b-3876-d450-a3af-797e47690000)
‘2023 Egypt Military Strength’ in Global Firepower (https://www.globalfirepower.com/country-military-strength-detail.php?country_id=egypt)
‘Comparison of Egypt and Israel Military Strengths (2023)’ in Global Firepower (https://www.globalfirepower.com/countries-comparison-detail.php?country1=egypt&country2=israel)
‘IDF exemption for Haredim expires — but nothing’s likely to change, for now’ in The Times of Israel, 1 February 2021 (https://www.timesofisrael.com/idf-exemption-for-haredim-expires-but-nothings-likely-to-change-for-now/)
‘Haredi population growing twice as fast as overall Israeli population — report’ in The Times of Israel, 31 December 2020 (https://www.timesofisrael.com/haredi-population-growing-twice-as-fast-as-total-israeli-population-report/)
‘Statistical Report on Ultra-Orthodox Society in Israel’ in The Israel Democracy Institute (https://en.idi.org.il/haredi/2022/)
‘A Third of Israeli Female Soldiers Were Sexually Harassed in 2021, Report Says’ in Haaretz, 28 November 2022 (https://www.haaretz.com/israel-news/2022-11-28/ty-article/.premium/a-third-of-israeli-female-soldiers-were-sexually-harassed-in-2021-report-says/00000184-bee1-d136-affd-fff5ac590000)
‘Inequality between Israel’s Mizrahi, Ashkenazi Jews to be measured in new statistics’ in The Times of Israel, 10 September 2022 (https://www.timesofisrael.com/inequality-between-mizrahi-ashkenazi-jews-to-be-measured-with-new-statistics/)
‘Israeli tanks add drone protection cages, a lesson from Ukraine war’ in The Washington Post, 17 October 2023 (https://www.washingtonpost.com/national-security/2023/10/17/israel-tanks-drone-protection-gaza/)